জেলারের দুর্নীতি খুঁজতে গিয়ে ৪৯ কর্মকর্তা ধরা

>
  • চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার
  • তদন্ত প্রতিবেদন
  • ৪৪ লাখ টাকা সোহেল রানার ‘নিজের’
  • কারাগার থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি
সোহেল রানা বিশ্বাস।
সোহেল রানা বিশ্বাস।

জেলার নিজেই এখন জেলে। তবে তাঁর দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে কারা বিভাগের ১ জন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও ২ জন জ্যেষ্ঠ জেল সুপার, ৭ জন ডেপুটি জেলারসহ ৪৯ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা এর আগেও একাধিকবার দুর্নীতির দায়ে বিভাগীয় শাস্তি (মামলা, বদলি ও অন্যান্য) পেয়েছেন। নতুন জায়গায় বদলি হয়ে আবার দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তাঁরা।

গত বছরের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন।

সোহেল রানার এই অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মনিরুল আলমের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সোহেল রানার কাছ থেকে জব্দ করা টাকা সরকারি নাকি তাঁর ব্যক্তিগত, ব্যক্তিগত হলে এর উৎস কী, টাকা কোথায় বা কার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল—এসবসহ চট্টগ্রাম কারাগারের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি এবং প্রতিরোধের সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে।

কমিটি সম্প্রতি কারা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সৈয়দ বেলাল হোসেন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোহেল রানার কাছ থেকে ভৈরব রেলওয়ে পুলিশের জব্দ করা টাকা ‘সরকারি’ নয়। ওই ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসের ‘নিজের’। এ ছাড়া সোহেল রানা চট্টগ্রামের কারাগারের বিভিন্ন তহবিল থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬০২ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

কমিটি জানতে পেরেছে, এ ঘটনায় যাঁরা দোষী বলে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অন্য কর্মস্থলেও অনিয়মের অভিযোগ ছিল। তদন্ত কমিটি সোহেল রানার গ্রেপ্তারের পর বদলি হওয়া তৎকালীন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক (বর্তমানে সিলেটে কর্মরত) এবং জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে (বর্তমানে বরিশালে কর্মরত) বিভিন্ন অনিয়মের জন্য দায়ী করেছে। সোহেল রানার পাশাপাশি পার্থ গোপাল বণিক ও প্রশান্ত কুমার বণিকের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোহেল রানার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষের তৎকালীন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক এবং জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে ঢাকায় হস্তান্তরের কথা ছিল। গত ২ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে জেলার সম্মেলনে এই কর্মকর্তাদের আসার কথা ছিল। কমিটি বলেছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক ও সোহেল রানার নিজেদের মধ্যে চালাচালি করা সাংকেতিক খুদে বার্তা এবং জেল সুপার ও অন্য সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ঘটনার সময় চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক। এখন তিনি আছেন সিলেটে। প্রথম আলোকে পার্থ গোপাল বণিক বলেন, ‘তদন্ত হয়েছে সোহেল রানাকে নিয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একজন অপরাধীর বক্তব্য শুনে আমাদের দায়ী করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাইনি, সেহেতু এখনই এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ প্রায় একই কথা বললেন তদন্তে দোষী সাব্যস্ত জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক। এখন তিনি বরিশালে কর্মরত। প্রশান্ত বণিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন চট্টগ্রামের জেল সুপারের দায়িত্ব নিই, তখনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় সভা হয়। তাতে চট্টগ্রাম কারাগারের অনিয়মের বিষয়ে আলোচনা হয়। তার মানে দুর্নীতি আগে থেকেই হচ্ছিল। আর আমাকে সরিয়ে যে কর্মকর্তাকে চট্টগ্রামে দেওয়া হলো, তাঁকে একসময় অনিয়মের অভিযোগে সিলেট থেকে বরিশালে বদলি করা হয়েছিল। এসব অসংগতি কমিটির বিবেচনা করা উচিত।’

অভিযুক্ত ৪৯ জন
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবহেলায় জড়িত ব্যক্তিরা হলেন এই কারাগারের তখনকার ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস, ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ মুনীর হোসাইন, মো. ফখর উদ্দিন, মো. আতিকুর রহমান, মুহাম্মদ আবদুস সেলিম, হুমায়ন কবির হাওলাদার, মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ জাবেদ হোসেন, সহকারী সার্জন ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিন, রামেন্দু মজুমদার পাল, কর্মচারী লায়েস মাজহারুল হক।

কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে রয়েছেন মো. আবুল খায়ের, নূর আলম, গাজী আবদুল মান্নান, মো. তাজউদ্দিন আহমেদ, আবদুর করিম, মোসলেম উদ্দিন, বেলাল হোসেন, হিসাবরক্ষক এমদাদুল ইসলাম, ক্যানটিন ম্যানেজার উলিউল্লাহ, এইচ এম শুভন, কাউছার মিয়া, আরিফ হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মিতু চাকমা, শহিদুল মাওলা, শরিফ হোসেন, জুয়েল রানা, আনোয়ার হোসেন, স্বপন মিয়া, মহসিন দপাদার, আনজু মিয়া, লোকমান হাকিম, শিবারন চাকমা, ত্রিভূষণ দেওয়ান, অংচহ্না মারমা, রুহুল আমিন, শাহাদাত হোসেন, শাকিল মিয়া, আবদুল হামিদ, ইকবাল হোসেন, শামীম শাহ, মো. উসমান, মো. বিল্লাল হোসেন ও অডিট টিমের সদস্য আবু বকর সিদ্দিকী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া ও কম গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বদলির সুপারিশ করেছে কমিটি।

প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
কারা অধিদপ্তরে দায়িত্বকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সোহেল রানার বিরুদ্ধে ছয়টি বিভাগীয় মামলা রুজু করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও তাঁর দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের তখনকার জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী (বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে) দায়িত্ব পালনের সময় থেকে অভিযুক্ত সোহেল রানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছেন। ইকবাল কবির চৌধুরীর দায়িত্বকালে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁর দায়িত্বকালীন (২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত) ৩৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৬৫ টাকা খরচ তছরুপ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই সময় চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের হিসাবরক্ষক এমদাদুল, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বিধিবহির্ভূতভাবে এ টাকা খরচ করে আর্থিক অনিয়ম করেছেন। কিন্তু অডিট টিমের সদস্য আবু বকর সিদ্দিকী অডিটে তার বৈধতা দিয়েছেন। এঁদের সবার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

চট্টগ্রাম কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল কারণ কারা ক্যানটিন। এর সঙ্গে আছে বন্দী বেচাকেনা, জামিন–বাণিজ্য, সিট–বাণিজ্য, সাক্ষাৎ–বাণিজ্য। কারা হাসপাতাল ও ওয়ার্ডে টাকার বিনিময়ে বন্দী বিক্রি হয়ে থাকে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে এসব অনিয়ম জেলার এবং জ্যেষ্ঠ জেল সুপারদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে সংঘটিত হয়েছে। সেখানকার ডিআইজি এসব অনিয়মের বিষয়ে জানলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে ব্যবস্থা না নিয়ে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন।

কারা ক্যানটিনের দায়িত্ব কারারক্ষীদের মধ্যে বণ্টনকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০-৫০ লাখ টাকা কথিত নিলাম তোলা হয়। এই টাকা জেলার, জেল সুপার এবং ডিআইজিরা ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেন। জেলার, জেল সুপার, ডিআইজি তাঁদের নিজেদের মনোনীত কারারক্ষীদের মধ্যে কথিত নিলামের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন করেন। নগদ টাকায় ক্যানটিনের মালামাল বন্দীদের মধ্যে বিক্রয় করা হয়। কারারক্ষী, জেলার, জেল সুপার এবং ডিআইজিকে অবৈধ অর্থ দিতে কারা ক্যানটিনের পণ্যের দাম বন্দীদের কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি নেওয়া হয়। নগদ টাকায় বিক্রি করে যে লাভ পাওয়া যায়, তার মধ্যে ৭৫ হাজার টাকা প্রতি মাসে জেলারকে দেওয়া হয়। পরে এ টাকা আনুপাতিক হারে জেল সুপার এবং ডিআইজির মধ্যে বণ্টন করা হয়।

কমিটি বলেছে, অনিয়ম এ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আদায়ের বিষয়টি ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে যশোরে থাকাকালে ২১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্থ গোপাল বণিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মো. ইকবাল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুপারিশ অনুযায়ী ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে, বাকিদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’