বেতন অনিয়মিত ৮৫% পৌরসভায়

>
  • ঢাকা বিভাগের ৬৩টি পৌরসভার মধ্যে নিয়মিত বেতন হয় মাত্র ১৮ টিতে 
  • সিলেট বিভাগের ১৯টি পৌরসভার মধ্যে শুধু কুলাউড়ায় নিয়মিত বেতন হয়

নিজস্ব আয় না থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে পারছে না দেশের বেশির ভাগ পৌরসভা। সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে ২৭৮টি পৌরসভায়। এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছেন বগুড়ার সান্তাহার পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ৬৫ মাস ধরে তাঁদের বেতন অনিয়মিত। বকেয়ার পরিমাণ ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সান্তাহার পৌরসভায় সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত (মাসিক বেতনভুক্ত) ২ জন কর্মকর্তা এবং ৩২ জন কর্মচারী রয়েছেন। দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে রয়েছেন আরও ১২৮ জন কর্মী। সবার বেতন-ভাতা দিতে বছরে প্রয়োজন ১ কোটি ৫০ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

সান্তাহার পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু বেতন হয়। দোকানে বহু টাকা বাকি, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করা নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন লঙ্ঘন করে গ্রামীণ অনেক এলাকাকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব পৌরসভার নিজস্ব আয়ের তেমন কোনো উৎসও নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় হওয়া এসব পৌরসভায় নাগরিক সুবিধা বলেও কিছু নেই।

দেশে ৩২৭টি পৌরসভা রয়েছে। এসব পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৪৯টির পৌরসভায় বেতন-ভাতা নিয়মিত হচ্ছে। বাকি ৮৫ শতাংশ পৌরসভাই কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারছে না।

পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল আলীম বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়েও বেতন না পাওয়ায় মাসের পর মাস তাঁরা আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অনেক অনুপযোগী অঞ্চলকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে শতভাগ কর আদায় হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, পৌর কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শাস্তি দেয় সরকার। কিন্তু বেতন হয় পৌরসভার নিজস্ব তহবিল থেকে।

পৌরসভার নিজস্ব আয়ের উৎসের মধ্যে রয়েছে হাটবাজার ইজারা, বাসিন্দাদের কাছ থেকে পৌরকর আদায়, সম্পত্তি হস্তান্তরের ফি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন ফি, রিকশা-ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স ফি।

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারায় পৌরসভাকে সরকারের একটি প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আইনের ৯১ (৪-এর ক) ধারায় বলা আছে, পৌরসভার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা এর তহবিল থেকে দিতে হবে। তবে স্থানীয় সরকারের আরেক প্রশাসনিক ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে বেতনের ২৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেওয়ার বিধান রয়েছে। সরকারি বরাদ্দ বাকি ৭৫ শতাংশ। একই ধরনের প্রশাসনিক ইউনিট হলেও বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

দেশের পৌরসভাগুলোতে কর্মকর্তা–কর্মচারী ৩৫ হাজার ১৩৪ জন। এর মধ্যে স্থায়ী কর্মী ১২ হাজার ৬৯৬ জন। বাকিরা চুক্তিভিত্তিক কর্মী। সরকার চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় পৌরসভাগুলোর বেতন-ভাতা খাতে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে, যা চাহিদার ১ শতাংশের কম। সরকারের রাজস্ব খাত থেকে বেতন–ভাতা দিতে আগামী বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

২০১৭ সালের জুনে বেতন-ভাতা অনিয়মিত ছিল দেশের ৬০ শতাংশ পৌরসভায়, কিন্তু বর্তমানে বেতন-ভাতা অনিয়মিত হওয়া পৌরসভার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আগের বেতন স্কেল অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে ব্যয় হতো ৩৫৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে সরকার নতুন বেতন স্কেল চালু করলে বেতন-ভাতা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়। পাশাপাশি বাড়াতে হয় চুক্তিভিত্তিক ও মাস্টাররোলে কর্মরত ব্যক্তির বেতনও।

পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে ৫১ মাস, টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ৩৯ মাস, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে
৩৪ মাস, ভোলার লালমোহনে ৩২ মাস, রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ৩০ মাস, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৩০ মাস, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ২৯ মাস, দিনাজপুরের হাকিমপুরে ২৮ মাস ও নোয়াখালীর কবিরহাট পৌরসভায় ২৫ মাসের বেতন অনিয়মিত।

চারটি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়মিত বেতন-ভাতা না পেয়ে তাঁদের কেউ শিক্ষার্থী পড়িয়ে, কেউ অফিস শেষে দোকান চালিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন। এই অবস্থায় সেবা নিতে আসা লোকজনের কাছ থেকে নানা কায়দায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়তি টাকা নেওয়ার চেষ্টাও করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা এবং এর সমাধানের বিষয়ে সুপারিশ দিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মো. মাহবুব হোসেনকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়েছে। জানতে চাইলে মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার বেতন-ভাতার সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছে। আগামী সপ্তাহে সুপারিশ জমা দেওয়া হবে।

টাকা না থাকায় অবসরের পর প্রাপ্য অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন পৌরসভার ৯৭৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে (গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) গেছেন। তাঁদের অবসরকালীন ভাতা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২০ কোটি টাকা।

পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের ৩৬টি পৌরসভার মধ্যে শুধু কুষ্টিয়া ও যশোরের মনিরামপুর পৌরসভায় নিয়মিত বেতন-ভাতা হয়। বরিশাল বিভাগের ২৬টি পৌরসভার মধ্যে বরিশালের উজিরপুর, পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন।

যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও করা পৌরসভাগুলোর আর্থিক অবস্থা বেশি দুর্বল বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভাগুলোর নিজের আয়ে চলার সামর্থ্য নেই। আবার এসব গ্রামীণ নগরকে কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা আর্থিক সমর্থন দেওয়ার কথা, সেখানেও ঘাটতি আছে। সুনির্দিষ্ট জনবলকাঠামো করে কেন্দ্রীয় সরকারকে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।