এক বিপদ এড়াতে গিয়ে আরেক ঝুঁকি

>
  • একবার পানি এনে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়
  • সেই পানি দূষিত হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে
  • বাড়ে রোগের প্রকোপ, শিশুমৃত্যু হার

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ার পর মানুষকে পানির উৎস পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তখন বেশির ভাগ মানুষ নলকূপ বাদ দিয়ে গভীর নলকূপসহ ভূপৃষ্ঠস্থ উৎসের পানি ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু এসব উৎস বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় একবার পানি এনে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়। এতে সেই পানি দূষিত হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ফলে বাড়তে থাকে ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগের প্রকোপ। বাড়ে শিশুমৃত্যুর হার।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এ গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমন দাবি করেছেন গবেষকেরা। গবেষণাটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কেমব্রিজভিত্তিক বেসরকারি অলাভজনক গবেষণা সংগঠন ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর)। এতে নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের গবেষক নিনা বুচম্যান। এনবিইআরের ওয়েবসাইটেও গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।

বরিশালের ১৬২টি গ্রামের ৩ হাজার ১৬০টি বাড়ি থেকে নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই সব বাড়িতে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া ১২ হাজার শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এতে দেখা যায়, ২০০৪ সাল নাগাদ যেসব পরিবার নলকূপ বাদ দিয়ে বাড়ি থেকে দূরের পানির উৎসকে বেছে নিয়েছিল, সেই সব পরিবারে শিশুমৃত্যুর হার বাড়ির নলকূপ থেকে পানি পান করা পরিবারগুলোর তুলনায় চার গুণ বেশি।

গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে জনগণের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে সরকার সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি নলকূপ স্থাপনে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এই সময়ে সরকারি উদ্যোগেও অনেক জায়গায় নলকূপ স্থাপন করা হয়। সরকারের এই উদ্যোগ সফল হয়। নতুন বিপদ হয়ে দেখা দেয় আর্সেনিক। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে দেশের অনেক জায়গায় বিষাক্ত আর্সেনিক ধরা পড়তে শুরু করে। আর্সেনিক একটি খনিজ উপাদান। মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ক্যানসারসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে।

১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক দাতা ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সহযোগিতায় সরকার ৫০ লাখের বেশি নলকূপ পরীক্ষা শুরু করে। যেসব নলকূপের পানি আর্সেনিক-দূষিত, সেগুলো লাল চিহ্নিত করে সেই নলকূপের পানি পান না করতে বলা হয়। নিরাপদ নলকূপগুলোয় সবুজ রঙের চিহ্ন আঁকা হয়।

গবেষকেরা জানিয়েছেন, আর্সেনিক-দূষণ থেকে রক্ষা পেতে সরকার নিরাপদ পানির বিকল্প উৎস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে গভীর নলকূপের পানি পানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ আরও কিছু বিকল্প পরামর্শ দেওয়া হয়। আর্সেনিক-দূষিত এলাকাগুলোয় দেখা গেল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গভীর নলকূপ বাড়ি থেকে বেশ দূরে দূরে। ফলে পানি এনে বেশ কয়েক দিন সংরক্ষণ করে রাখছে মানুষ। এ ছাড়া বাড়ির পাশের পুকুর, খাল-বিলের পানিও ব্যবহার করতে শুরু করে তারা। কিন্তু পানি সংরক্ষণের নিয়ম ঠিকভাবে না মানায় এবং পুকুর, খাল-বিলের পানি ঠিকভাবে পরিশোধন না করায় ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এদিকে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করার কারণে মানুষ পানি পানও কমিয়ে দেয়। ফলে পানিশূন্যতাজনিত সমস্যাও বাড়তে শুরু করে। এসব কারণে শিশু ও নবজাতকের মৃত্যুহার বেড়ে যায়।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, আর্সেনিক-দূষণ রোধে বিকল্প উৎসের পানি ব্যবহারের প্রচারণা জীবন বাঁচানো একটি উদ্যোগ হলেও তা একপর্যায়ে ‘নেতিবাচক’ হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রাখার আহ্বান জানানো হয় প্রতিবেদনে।