ওয়াসার এমডি খান তিন রকমের পানি

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। ফাইল ছবি
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। ফাইল ছবি

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের দাবি, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়। তাহলে তিনি কি এই পানি পান করেন?

তাকসিম এ খান নিজেই জানালেন, ওয়াসার শতভাগ সুপেয় পানি তিনি সব সময় পান করেন না। তিনি তিন রকমের পানি পান করেন। যেমন—বাড়িতে ফুটিয়ে, বাইরে শান্তি বোতলের আর মাঝেমধ্যে ট্যাপের পানি।

গতকাল শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাকসিম এ খান এ তথ্য জানান। ঢাকা ওয়াসাকে নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) করা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়।

গতকাল এ কথা বললেও গত ২৮ মার্চ কারওয়ান বাজারে ওয়াসার প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকসিম এ খান নিজেই ১০ মিনিট পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা একটু ফুটিয়ে খান, ১০ মিনিট পানিটা ফুটিয়ে খান।’

তাকসিম এ খান অবশ্য গতকাল দাবি করলেন, ওয়াসা যেখান থেকে পানি সরবরাহ করে (উৎস), সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা ‘পাইপলাইন’। পাইপলাইনে ফুটো, ভাঙা ও বাড়িতে পানির ট্যাংকে ময়লার কারণে পানি দূষিত হয়।

তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমরা বিরাট উদ্যোগ নিয়ে পাইপলাইনগুলো বদলাচ্ছি। ২০২১ সালে আমরা বলব যে আসেন “ট্যাপ ওয়াটার” খান।’

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, গত ১১-২৯ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে ২৪৩টি পানির নমুনা সংগ্রহ করে ওয়াসা পরীক্ষা করে সন্তোষজনক ফল পেয়েছে।

ওয়াসার এমডির এই বক্তব্য গতকালই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ওয়াসার পানি খেয়ে অসুস্থ হলে এর দায় তিনি নেবেন কি না, এই প্রশ্ন করেছেন অনেকেই। সুপেয় পানির জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয়ের কথাও বলেছেন অনেকে।

গত বুধবার প্রকাশিত টিআইবির গবেষণায়ও এই বাড়তি অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হয়েছিল। টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, ওয়াসার নিম্নমানের পানির কারণে সেবাগ্রহীতাদের ৯১ শতাংশ ফুটিয়ে পানি পান করেন। এতে প্রতিবছর অন্তত ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়। তবে এ তথ্য নিয়ে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমাদের পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। কাজেই আপনি গ্যাস পোড়াচ্ছেন, এটা তো আমার কাছে আশ্চর্য কথা।’

ওয়াসার পানি নিয়ে গবেষণা আগেও হয়েছে। ২০১৭ সালে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম বদরুজ্জামান। গবেষণায় রাজধানীর ধানমন্ডি, কলাবাগান, লালমাটিয়া, মালিবাগ, বংশাল, নাজিরাবাজার, সূত্রাপুর এলাকার পানির মান পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ধানমন্ডি, কলাবাগান, লালমাটিয়া অঞ্চলের পানির চেয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানির মান বেশ খারাপ।

অধ্যাপক বদরুজ্জামান গতকাল শনিবার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণার ৪০ শতাংশ এলাকার পানিতে জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। আবার দেখা গেছে, শুকনো মৌসুমের চেয়ে বর্ষাকালে পানির মান বেশি খারাপ হয়। এটি প্রমাণ করে যে ওয়াসার সরবরাহের পানির সঞ্চালন লাইনে ফুটো আছে। যার ফলে পানি দূষিত হয়।’

এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে উঠে আসে যে দেশের ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করে। এই পানিতে আর্সেনিক এবং ই কোলাই (মলের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া) সংক্রমণ আছে। জরিপে দেখা যায়, গ্রামের চেয়ে ঢাকাসহ শহরের পানি বেশি মাত্রায় ই কোলাই সংক্রমিত। এর আগে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা ৬৩ শতাংশ পানিতেই ই–কোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

গত বুধবার প্রকাশিত টিআইবির ওই গবেষণায় ওয়াসার পানির মান ছাড়াও প্রায় এক–তৃতীয়াংশ গ্রাহকের সেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি, চাহিদা অনুযায়ী পানি না পাওয়া, অভিযোগ করে সমাধান না পাওয়া, সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া, ওয়াসার বোর্ডের কার্যকারিতায় ঘাটতি থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করা হয়। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এই গবেষণা প্রত্যাখ্যান করে তাকসিম এ খান বলেন, এই গবেষণায় পেশাদারির অভাব রয়েছে। এটি গবেষণা নয়, সাদামাঠা প্রতিবেদন। ওয়াসাকে হেয়প্রতিপন্ন ও বিব্রত করতেই এটি করা হয়েছে। বরং ওয়াসায় সুশাসন রয়েছে, দুর্নীতিমুক্ত এবং সংস্থাটি সক্ষম। ওয়াসার এমডি দাবি করেন, ব্যবস্থাপনা, কারিগরি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতায় ঢাকা ওয়াসা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনেক ভালো অবস্থানে আছে।

টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, ৬১ শতাংশ লোক অভিযোগ করে সমাধান পাননি। এ সম্পর্কে তাকসিম এ খান বলেন, ‘কলসেন্টারে ১১ হাজার ৩৬৭টি অভিযোগ জমা পড়েছিল, তার মধ্যে ১১ হাজার ২০৫টি অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে।’ সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসার বোর্ডের সদস্য ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম, পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।