দেশে কাঁকড়ার কৃত্রিম প্রজনন

>

* ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়।
* ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩১০ কোটি ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
* একটি পরিণত কাঁকড়া যে পরিমাণে ডিম পারে, তার ৫ শতাংশ বেঁচে থাকলে হ্যাচারিতে উৎপাদন লাভজনক হয়।

দেশে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি কমছে। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোর বেশির ভাগ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। দেশের ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়িশিল্পের এই হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে আশার আলো জ্বেলেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। দেশের মৎস্যজাতীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানি। কিন্তু এটি এত দিন ছিল প্রকৃতিনির্ভর। উপকূলীয় নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে কাঁকড়ার পোনা সংগ্রহ করে তা ঘেরে চাষ করা হতো এত দিন। এতে প্রকৃতিনির্ভর এই সম্পদ দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা এবার কাঁকড়ার কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া শিলা কাঁকড়ার এই কৃত্রিম প্রজননের ফলে এর পোনা এখন থেকে হ্যাচারিতে উৎপাদন করা যাবে। বিএফআরআইয়ের খুলনার পাইকগাছায় অবস্থিত লোনা পানি কেন্দ্রে ২০১৫ সাল থেকে হ্যাচারিতে শিলা কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের জন্য গবেষণা শুরু করা হয়। গবেষক দলে ছিলেন কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক মো. লতিফুল ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মামুন সিদ্দিকী। দীর্ঘ গবেষণার পর চলতি মাসের শুরুর দিকে গবেষক দলটি হ্যাচারিতে শিলা কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছে।

এখন থেকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করা যাবে। কাঁকড়া সাধারণত স্বজাতিভোজী। অর্থাৎ বড় পোনা ছোট পোনাগুলোকে খেয়ে ফেলে। কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একটি পরিণত কাঁকড়া যে পরিমাণে ডিম পাড়ে, তার ৫ শতাংশ যদি বেঁচে থাকে, তাহলেই হ্যাচারিতে তা উৎপাদন লাভজনক হয়। এ পর্যন্ত ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া এই কৃত্রিম প্রজননে সফলতা পেয়েছে। কাঁকড়ার বৈশ্বিক বাজার এই দেশগুলোর দখলে।

কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে গবেষণার এই সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. লতিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় কমপক্ষে ৫ শতাংশ কাঁকড়ার ডিম বেঁচে থাকছে। এই সাফল্য ছড়িয়ে দিতে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যারা কাঁকড়া চাষ করে, তাদের জন্য আমরা বাংলায় একটি নির্দেশিকা (কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন) তৈরি করছি। যারা কাঁকড়ার হ্যাচারি তৈরি করবে, তাদের হাতে-কলমে সহযোগিতা দিতেও আমরা প্রস্তুত।’

বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানী ও কাঁকড়া গবেষকেরা বলছেন, শিলা কাঁকড়া ম্যানগ্রোভ উপকূলীয় এলাকায় বাস করে। ডিম দেওয়ার জন্য এরা সাগরে যায়। বর্তমানে প্রকৃতি থেকে শিলা কাঁকড়ার পোনা সংগ্রহ করে মূলত সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে এর চাষাবাদ হয়।

জানতে চাইলে ২০১৬ সালে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার বিজয়ী কাঁকড়াচাষি ও রপ্তানিকারক অং ছিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় সব সময় প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁকড়ার পোনা পাওয়া যায় না। ফলে রপ্তানির অনেক সুযোগ থাকলেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারতাম না। কৃত্রিম প্রজননের ফলে কাঁকড়ার পোনার সরবরাহ ও উৎপাদন একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। বিশ্ববাজারে কাঁকড়ার যে বড় বাজার তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ তা ধরতে পারবে।’

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় প্রাকৃতিক উৎসের ওপর চাপ কমবে এবং দেশে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষাবাদ সহজতর হবে।

খাবার হিসেবে বাংলাদেশে শিলা কাঁকড়ার খুব একটা কদর না থাকলেও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, হংকং ও কোরিয়াতে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সীমিত আকারে এসব দেশে শিলা কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার কাঁকড়া রপ্তানি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩১০ কোটি ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের পরিচালক জাহেদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখছিল। কৃত্রিম প্রজননের ফলে প্রকৃতির ওপর চাপ কমবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে আর দেশের এই শিল্প চিংড়ির বিকল্প রপ্তানি পণ্য হিসেবে গড়ে উঠবে।