ছয় বছরেও এগোয়নি হত্যার বিচার

সাভারে ধসে পড়া নয়তলা ভবন। ধ্বংসস্তূপের ফাঁকফোকরে দাঁড়িয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। ফাইল ছবি
সাভারে ধসে পড়া নয়তলা ভবন। ধ্বংসস্তূপের ফাঁকফোকরে দাঁড়িয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। ফাইল ছবি

দুজন আসামির পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ আছে। কেবল রানা প্লাজা ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ঢাকা জেলার সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) দপ্তর থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

ছয় বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৬ জন। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও ১ হাজার ১৬৯ জন। এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে।

প্রায় তিন বছর আগে হত্যার অভিযোগে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

নিখোঁজ স্বজনের ছবি ও পরিচয়পত্র হাতে শত শত মানুষ সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হন। ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধার করা মৃতদেহগুলো সেখানেই রাখা হয়। ফাইল ছবি
নিখোঁজ স্বজনের ছবি ও পরিচয়পত্র হাতে শত শত মানুষ সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হন। ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধার করা মৃতদেহগুলো সেখানেই রাখা হয়। ফাইল ছবি

ঢাকা জেলা পিপির দপ্তর থেকে গত রোববার বলা হয়েছে, অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আটজন আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে এই আটজনের পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আসে। ইতিমধ্যে ছয়জন আসামির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। কেবল সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে স্থগিতাদেশ বহাল আছে। রেফায়েত উল্লাহর স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী ৯ মে পর্যন্ত। আর মোহাম্মদ আলীর পক্ষে আগামী জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

ছয় বছরেও হত্যা এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক ফৌজদারি মামলা ছাড়া অন্য কোনো ফৌজদারি মামলায় রাষ্ট্রের স্পষ্টতই মাথাব্যথা নেই। এ কারণেই হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। রানা প্লাজা ভবনের হতাহতের ঘটনার এসব মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে। যত দিনে বিচারকাজ আবার শুরু হবে তত দিনে সাক্ষ্যপ্রমাণ আলামত অনেক কিছুই নষ্ট হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, দুজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশের কারণে হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি বিচারিক আদালতের সরকারি কৌঁসুলিরা তাঁকে জানাতে পারতেন। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা।

তবে ঢাকা জেলার প্রধান সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, স্থগিতাদেশ থাকার কারণে রানা প্লাজা ধসের হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম যে বন্ধ আছে, তা চিঠি দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল দপ্তরকে জানিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম চালানোর সুযোগ নেই। তিনি শিগগিরই অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।

এর আগে রানা প্লাজা ধসের জন্য ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিন বছর ঝুলে ছিল এই মামলা। সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল—যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি দিতে পারবে না তারা। শেষ পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই অভিযোগ গঠন করেন।

রানা প্লাজা ধসে পড়া ভবনের ভেতর থেকে ১০০ ঘণ্টা পর জীবিত অবস্থায় বের করে আনা হয় পোশাক কারখানার মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপক কিউ এম এ সাদিককে। ফাইল ছবি
রানা প্লাজা ধসে পড়া ভবনের ভেতর থেকে ১০০ ঘণ্টা পর জীবিত অবস্থায় বের করে আনা হয় পোশাক কারখানার মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপক কিউ এম এ সাদিককে। ফাইল ছবি

আদালত সূত্র বলছে, রানা প্লাজা ধসের হত্যা মামলায় ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন একজন। তিনি হলেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক সোহেল রানা। জামিনে আছেন ৩২ আসামি। পলাতক আছেন ছয়জন। মারা গেছেন দুই আসামি।

অভিযোগপত্র কী বলছে

রানা প্লাজা ধসের হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে সাভার থানা-পুলিশ। এরপর তদন্ত করে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সর্বশেষ পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান। ছবি: আসাদুজ্জামান

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে নয়টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম যেন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু পাঁচজন গার্মেন্টস মালিক এবং তাঁদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরের দিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, ‘আগামী এক শ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, রানা প্লাজা ভবন তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন ভবনটির মালিক খালেক এবং তাঁর ছেলে সোহেল রানা। যা রানা প্লাজা ভবনকে একটি মৃত্যুকূপে পরিণত করে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, বাণিজ্যিক এই ভবনে পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে গার্মেন্টস কারখানাগুলোয় তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবন বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে।

আরও একটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ
ইমারত নির্মাণ আইনে মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজিএম) আদালত পরের বছর ১৪ জুন অভিযোগ গঠন করেন। ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন।

সাভারে ধসে পড়া নয়তলা ভবন । ধ্বংসস্তূপের ফাঁকফোকরে দাঁড়িয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। ফাইল ছবি
সাভারে ধসে পড়া নয়তলা ভবন । ধ্বংসস্তূপের ফাঁকফোকরে দাঁড়িয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। ফাইল ছবি

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর রোববার প্রথম আলোকে বলেন, রিভিশন আবেদন করায় ইমারত আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ আছে। সিজিএম আদালতে নথি আসার পর সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে। তবে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম চলছে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। ২০১৭ সালের ২১ মে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনার বিচার ছয় বছরেও শেষ না হওয়ায় চরম হতাশ বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে এত মানুষ মারা গেলেন, এত মানুষ পঙ্গু হলেন। ছয় বছরেও বিচার না হওয়ায় হতাহতদের চরম অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে। এই মানুষগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে—তোমরা আমাদের কাছে কিছুই না। শ্রমিকদের যদি মূল্য থাকত, তাহলে এই হত্যার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করা উচিত ছিল।’

রানা প্লাজার তিনতলায় নিউ ওয়েভ বটম নামে একটি পোশাক কারখানায় কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে সাদিক কাজ করতেন। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে উদ্ধার করা হয় তাঁকে। মঙ্গলবার সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় বছর হয়ে গেল, বিচার শেষ হলো না। আমরা বিচার চাই।’ রানা প্লাজা ধসে পঙ্গু হয়ে যাওয়া গার্মেন্টসকর্মী নিলুফা বেগম বলেন, এত বছর হয়ে গেল, এখনো বিচার শেষ হলো না। রানাসহ অন্যদের বিচার চাই। শাস্তি চাই।’