এত দিনেও থামেনি স্বজনহারাদের কান্না

দারিদ্র্যের সঙ্গে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রামের রাবেয়া বেগমের লড়াই শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। বিয়ের তিন বছরের মাথায় তাঁর স্বামী জাফর আলী অন্যত্র বিয়ে করেন। ছয় মাসের শিশুকন্যাকে নিয়ে রাবেয়া আশ্রয় নেন তাঁর বৃদ্ধ মায়ের কাছে। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সন্তানের মুখে ভাত তুলে দেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করে রাবেয়ার মেয়ে ইয়াসমিন আকতার। কলেজে ভর্তির টাকা জোগাতে না পেরে ধারদেনা করে মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দেন। তাঁর জামাতা বাসচালকের সহকারী, মাদকসেবী। শুরু হয় ইয়াসমিনের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন। একদিন স্বামীর ঘর ছেড়ে ইয়াসমিন চার বছরের ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নেন তাঁর মা রাবেয়ার কাছে। এরপর ছেলেটিকে মায়ের কাছে রেখে ইয়াসমিন সাভারে রানা প্লাজার তৃতীয় তলার একটি পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ নেন। মাস শেষে ইয়াসমিন কিছু টাকা পাঠাতেন মায়ের কাছে। সেই টাকায় সন্তানের পড়াশোনার খরচ চলত। একদিন রানা প্লাজা ধসে পড়ল। খবর পেয়ে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান মা রাবেয়া। ইয়াসমিনের ছবি নিয়ে সাভারের অধর চন্দ্র বিদ্যালয় থেকে জুরাইন কবরস্থান পর্যন্ত কয়েক দিন ছোটাছুটি করেন। কিন্তু মেয়ের কোনো সন্ধান পাননি। এরপর হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

জানতে চাইলে রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের লাশের সন্ধানে কত ছোটাছুটি করলাম! মেয়ের লাশটাও খুঁজে পেলাম না। তিন বছর পর ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেলাম। জানানো হলো, জুরাইন গোরস্থানে ১২০ নম্বর কবরটা ইয়াসমিনের। বছর ঘুরে দিনটা আসে। জুরাইন কবরস্থানে ছুটে যাই। মেয়ের কবরের পাশে বসে চোখের পানি ফেলি।’

রাবেয়া আরও বলেন, ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চালাকি করে তা তাঁর সাবেক জামাতা হাতিয়ে নিয়েছেন।

আজ বুধবার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ছয় বছর পূর্ণ হচ্ছে। কিন্তু এত দিনেও থামেনি স্বজনহারাদের কান্না। বছর ঘুরে দিনটি এলেই রাবেয়া বেগমের মতো বগুড়ার ২৭ শ্রমিকের স্বজনেরা এক বুক কষ্ট নিয়ে ছুটে যান। তাঁরা সাভারে রানা প্লাজা আর জুরাইন কবরস্থানে এখনো ছুটোছুটি করেন। নিহত স্বজনদের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।

রানা প্লাজায় ইয়াসমিনের সঙ্গে একই কারখানায় কাজ করতেন তাঁর মামাতো ভাই মামুন মিয়া। দুর্ঘটনায় ভবনের নিচে আটকা পড়লেও শৌচাগারের পাইপ বেয়ে ভাঙা সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিনি। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

মামুন মিয়া বলেন, ‘হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। জেনারেটর চালু করতেই প্রচণ্ড শব্দে ভবন কেঁপে ওঠে। এরপর ঘুটঘুটে অন্ধকার। সিঁড়িপথও ধসে গেছে। অন্ধকার ভবনে চিৎকার-আর্তনাদ। ইয়াসমিনকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু অন্ধকার ভবনে কিছুই দেখা যায় না। বাঁচার সম্ভাবনা যখন ক্ষীণ, তখন ভাঙা ভবনের সুড়ঙ্গ পথে আলোর রেখা দেখতে পাই। ওই পথে ভবন থেকে বের হয়ে শৌচাগারের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচাই।’

প্রতিবছর এই দিনে সাভারে রানা প্লাজা আর জুরাইন কবরস্থানে ছেলে সুলতান আর মেয়ে আছমাকে হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে ছোটাছুটি করেন নন্দীগ্রাম উপজেলার কাথম গ্রামের হতদরিদ্র মা অবিরুল বেগম। তিনি নিজেও কাজ করতেন রানা প্লাজার তৃতীয় তলায়। তবে দুর্ঘটনার দিন কাজে যাননি। তাঁর ছেলে সুলতান ও মেয়ে আছমা কাজে গিয়েছিলেন। এরপর তাঁদের লাশও পাওয়া যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলে সাত মাস পর জুরাইন কবরস্থানে খুঁজে পান শুধু মেয়ে আছমার কবর। কিন্তু ছেলে সুলতানের লাশের সন্ধান আজও পাননি।

অবিরুল বেগম বলেন, ‘বছর ঘুরে দিনডা আসলেই বুকটা হুহু করে ওঠে। বুকের দুডা ধন। এক সাথে হারাচি। এখন পাকা বাড়ি পাইচি, হাড়িত ভাত আচে কিন্তু বুকত শান্তি নাই।’

নন্দীগ্রাম উপজেলার থালতা গ্রামের আমজাদ হোসেনের স্ত্রী পিয়ারা বেগম এবং কন্যা জাহানারা পারভীন রানা প্লাজার একটি কারখানায় কাজ করতেন। ভবন ধসের পর জাহানারাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ১৭ দিন পর ভবন থেকে উদ্ধার করা হয় মা পিয়ারা বেগমের লাশ।

জাহানারা বেগম বলেন, ‘চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু হলো। মৃত্যুপুরী থেকে কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ফিরেছি। তবে এখন পঙ্গু জীবন যাপন করছি। এখনো দিনটার কথা মনে হলে আঁতকে উঠি।’

বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বগুড়ার ২৮ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ২৩ জনের লাশের সন্ধান মিললেও পাঁচজনের হদিস মেলেনি।