ওয়াসার পানির শরবতে এমডি সাহেবের অনীহা

ঢাকা ওয়াসার পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ দাবি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। সেই বক্তব্যের প্রতিবাদে জুরাইন এলাকার পানি দিয়ে শরবত পান করাতে ওয়াসা ভবনের সামনে হাজির হয় রাজধানীর কয়েকজন বাসিন্দা। কারওয়ান বাজার, ২৩ এপ্রিল। ছবি: ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা ওয়াসার পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ দাবি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। সেই বক্তব্যের প্রতিবাদে জুরাইন এলাকার পানি দিয়ে শরবত পান করাতে ওয়াসা ভবনের সামনে হাজির হয় রাজধানীর কয়েকজন বাসিন্দা। কারওয়ান বাজার, ২৩ এপ্রিল। ছবি: ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান যে ‘আপেক্ষিক তত্ত্বের’ একনিষ্ঠ অনুসারী, সে কথা জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের জানা ছিল না। জানা থাকলে তিনি ভরদুপুরে সপরিবার এসে এমডি সাহেবকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতে চাইতেন না। মিজানুর রহমান জানতেন না, এমডি সাহেব ওয়াসার পানিকে সাধারণ ঢাকাবাসীর জন্য ‘শতভাগ নিরাপদ’ মনে করলেও নিজে সেই পানি খান না, সে পানির শরবত তো বহুদূর। ওয়াসার পানির বিশুদ্ধতা তাঁর মতে আপেক্ষিক বিষয়। তিনি মনে করেন, এই পানি সাধারণ ঢাকাবাসীর জন্য ‘শতভাগ নিরাপদ’, তবে তাঁর মতো ‘অসাধারণ লোক’দের জন্য ‘ওয়াক থু!’

কাল মঙ্গলবার দুপুরে ওয়াসা অফিসের সামনে হঠাৎ লোকজনের ভিড় লেগে গেল। বিষয় কী? মিজানুর রহমান নামে এক ভদ্রলোক ওয়াসার প্রধান অফিসে এসেছেন এমডিকে শরবত খাওয়ানোর বাসনায়। মিজানুর জুরাইনের নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়কারী। এই অপ্রত্যাশিত আপ্যায়নচেষ্টার হেতু সন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, টিআইবি ১৭ এপ্রিল একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছিল, ওয়াসার পানি এমনিতে মুখে দেওয়া যায় না। ৯১ শতাংশ গ্রাহকই এ পানি ফুটিয়ে খান। বাসাবাড়িতে পানি ফোটাতে বছরে ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস পোড়াতে হয়। এতে আম–পাবলিকের খরচ হয় ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এ কথা শোনার পর এমডি সাহেবের মেজাজ খুব বিগড়ে যায়।

গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমডি সাহেব টিআইবির ওই প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং আরও ম্যালা কিছু বলেন। যেসব কোম্পানি বোতলবন্দী পানি লিটারপ্রতি ৩০ টাকায় বিক্রি করে থাকে, সেসব কোম্পানির পেটে আঘাত করে এমডি সাহেব বলেন, ‘আমাদের পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। কাজেই আপনি গ্যাস পোড়াচ্ছেন, এটা তো আমার কাছে আশ্চর্য কথা!’ ওই দিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিরাট উদ্যোগ নিয়ে পাইপলাইনগুলো বদলাচ্ছি। ২০২১ সালে আমরা বলব যে আসেন, “ট্যাপ ওয়াটার” খান।’

তাকসিম এ খান
তাকসিম এ খান

আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এই মারাত্মক আশাজাগানিয়া কথাগুলো কোনো যদু–মধু বলেনি। বলেছেন ওয়াসার মহামান্য এমডি। তাঁর এমন কথায় সেদিন থেকেই বোতলজাত সব পানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। ওয়াসা শতভাগ বিশুদ্ধ টলটলে পানি দেওয়া সত্ত্বেও তা জ্বাল দিয়ে শুধু শুধু গ্যাস পোড়ানো আর বোতলের পানি কিনে খাওয়ার মতো আহাম্মকি দেখে এমডি সাহেবের ব্রহ্মতালু জ্বলে যাওয়ারই কথা। তবে সেদিন তিনি আরও একটি কথা জানিয়েছিলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় হলেও তা তিনি সব সময় খান না। তাঁর ভাষায়, ‘বাসার পানি ফোটানো হয়, আমি শান্তি বোতলের পানি (ওয়াসার বোতলজাত পানি) খাই, আর সবচেয়ে মজার হলো, ট্যাপের পানিটাও খাই। কাজেই আমি তিন রকমের পানি খাই।’

২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়া এমডি সাহেবের কথা শুনে জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান সাহেব তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। বউ–বাচ্চা নিয়ে গতকাল সোজা চলে এসেছেন ওয়াসা অফিসে। তাঁদের সঙ্গে এসেছিলেন পারিবারিক বন্ধু মতিয়ার রহমান ও পূর্ব রামপুরা থেকে মনিরুল ইসলাম। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ওয়াসার পানিভর্তি একটি কাচের জগ, একটি গ্লাস, এক প্যাকেট চিনি ও চারটি প্রমাণ সাইজের লেবু। একটি অব্যক্ত আবেগ থেকে এমডিকে এক গ্লাস শরবত খাওয়ানোর বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ এবং অফিসের লোকজন তাঁদের সে আবেগের কী মানে করেছিলেন, কে জানে? তাঁরা তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দেননি। ঢুকতে না পেরে অগত্যা সিঁড়ির ওপরই তাঁরা জগ–গ্লাস নিয়ে বসে পড়েছিলেন।

এমডি সাহেবকে গতকাল সাংবাদিকেরা ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মিজানুর সাহেবের শরবত তিনি খেতে উৎসুক কি না। জবাবে তিনি বলেছেন, যার–তার হাতের শরবত তিনি খান না। একটি অনলাইন পোর্টালকে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো খাব আমার পানি। আমি কোনটা খাব না খাব; সেটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ এখানে ‘আমার পানি’ বলতে তিনি ওয়াসার পানির কথা বুঝিয়েছেন কি না, সেটা অবশ্য ঠিক পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না।

তবে এমডি সাহেব যা বোঝাতে চেয়েছেন তার সারমর্ম অনেকটা এ রকম—সব মানুষ সমান নয়; আমজনতার জন্য যা ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’, তাঁর মতো ‘অসাধারণ’ মানুষের জন্য তা অশুদ্ধ। সর্বমহলে সুবিদিত দুর্গন্ধযুক্ত ওয়াসার পানি সাধারণ ঢাকাবাসীর জন্য ‘শতভাগ সুপেয়’ হলেও তাঁর কাছে তা অনিরাপদ। এ কারণে মিজানুর রহমানরা ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে খেলে কিছু হবে না। কিন্তু এমডি সাহেবের মতো মানুষের পক্ষে এ শরবত পরিত্যাজ্য। এই সারবান ভাবনার জন্য তাঁকে ‘আপেক্ষিক শরবত তত্ত্বে’র প্রবক্তার খেতাব দেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু দুশ্চিন্তার কথা হলো, আজ না হয় একজন মিজানুর শরবত খাওয়াতে ওয়াসায় এসেছেন। এরপর যদি আরও অনেকে আকুল হয়ে তাঁকে শরবত খাওয়াতে আসেন, তখন তিনি কি করবেন? আপেক্ষিক শরবত তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়ে কি এমডি সাহেব তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন?