সোনিয়াদের যন্ত্রণার জীবন, চাপা কান্না

ডান পা হারানো সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সায়েব মণ্ডলের মেয়ে সোনিয়া বেগম,ডান হাত হারানো গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিকতা খাতুন ও  বাঁ পা হারানো সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতগিরি গ্রামের দিনমজুর লাল মিয়ার মেয়ে লাভলী খাতুন। ছবি : প্রথম আলো
ডান পা হারানো সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সায়েব মণ্ডলের মেয়ে সোনিয়া বেগম,ডান হাত হারানো গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিকতা খাতুন ও বাঁ পা হারানো সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতগিরি গ্রামের দিনমজুর লাল মিয়ার মেয়ে লাভলী খাতুন। ছবি : প্রথম আলো

প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাটছে সোনিয়া বেগমের (২৪) জীবন। ঠিক ছয় বছর আগে ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজার সাততলায় সবে সেলাই মেশিনের কাজ শুরু করেছিলেন সোনিয়া। হঠাৎ বিকট শব্দে অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। বের হতে পারছিলেন না, ডান পা চাপা পড়ে একটি পিলারের নিচে। এভাবেই তিন দিন থাকার পরে উদ্ধার পেলেও শেষ পর্যন্ত ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। এরপর থেকেই শুরু চাপা কান্না আর যন্ত্রণার জীবন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার ধস এ রকম হাজারো পরিবারের দুর্যোগের কারণ হয়ে আছে। সাভার বাসস্ট্যান্ডের আটতলা রানা প্লাজার ছয়টি তলাতেই ছিল পোশাক কারখানা। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সর্বশেষ হিসাবে ভবন ধসে প্রাণ গেছে ১ হাজার ১৩৮ জনের। আহত ১ হাজার ১৬৭ জন, যার মধ্যে ২৭ জন অঙ্গ হারিয়েছেন। নিখোঁজ আছেন ১৫৮ জন।

রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গাইবান্ধার। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে গাইবান্ধার ৪৯ জন। আর ১১ জন নিখোঁজ ও শতাধিক আহত হন।

অঙ্গ হারানো শ্রমিক সোনিয়া, লাভলী খাতুন, রিক্তা খাতুনদের জীবন কাটছে ধুঁকে ধুঁকে। তাঁদের কাছে আগের জীবনটা এখন স্বপ্নের মতো, অন্তত সেখানে প্রতিদিনের যন্ত্রণাগুলো ছিল না।

জেলার সাদুল্যাপুরের দক্ষিণ দামোদরপুরে কথা হয় সোনিয়ার সঙ্গে। অনেকটা কিশোর বয়সেই বিয়ে হয় ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে স্বামীসহ রানা প্লাজার পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। চাকরির ২২ দিনের মাথায় ভবনটি ধসে পড়ে। স্বামী বাইরে থাকায় বেঁচে যান। ওই ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওয়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার করে টাকা পাচ্ছেন। এই টাকাতেই চলছে সংসার ও চিকিৎসা। সোনিয়া বলেন, শীতকালটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে হাজির হয়। ব্যথা করে, জ্বালা–যন্ত্রণা হয়। এ যন্ত্রণা অবর্ণনীয়। তখন প্রায়ই যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে।

আক্ষেপ করে সোনিয়া বলেন, ‘এক জীবনে যাদের কারণে এত কষ্ট পাইলাম, সেই লোকগুলোর এখনো শাস্তি হইতে দেখলাম না। এইটাও অনেক বড় কষ্ট।’

স্বামী মিজানুর আর সাড়ে তিন বছরের সন্তান নিয়ে তবু সোনিয়ার সংসারটা কোনোমতে চলছে। কিন্তু একই উপজেলার চকগোবিন্দপুরের রিক্তা খাতুন হাতও হারিয়েছেন, স্বামীও তাঁকে ছেড়ে গেছেন। এখন ক্ষতিপূরণের ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশে চলছে দুই সন্তান নিয়ে সংসার। আর কাটা হাতেও যন্ত্রণার শেষ নেই।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার লাভলী খাতুন (৩৭) রানা প্লাজায় বাঁ পা হারিয়েছেন। এরপর থেকেই খুঁড়িয়ে চলছে জীবন। তিনি বলেন, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ আর স্বামীর আয়ে সংসার চললেও যন্ত্রণাগুলো কমছে না। শীতকাল আসে খুবই কষ্ট নিয়ে। রানা প্লাজা ধসে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন লাভলীও।

সাদুল্যাপুরের নলডাঙ্গা গ্রামের বাঁ পা হারানো শিল্পী খাতুন জীবিকার তাগিদে আবারও ফিরেছেন সাভারে। তিনি কাজ করতে পারেন না, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। মুঠোফোনে শিল্পী বলেন, ‘হুইলচেয়ারে চলতে–ফিরতে হয়। এখনো ক্ষত জায়গায় জ্বালাপোড়া করে। খুবই কষ্ট করে বেঁচে আছি ছেলেমেয়ে দুইটার জন্য।’ এখন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ এবং স্বামীর ও গরু পালনের আয়ে চলছে সংসার।

নিখোঁজ–নিহতদের পরিবারগুলোর হতাশা

১১ বছরের কামরুল মিয়া এখন মায়ের কথা তেমন বলতেই পারে না। তার মা কামনা খাতুনের (২২) লাশটাও পাওয়া যায়নি। সাদুল্যাপুরের দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা। একই গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে বীথি খাতুনেরও (২১) লাশ পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামে কথা হয় সোনা মিয়া ও আবদুল বারীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, কোনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি তাঁরা। আবদুল বারী বলেন, ‘ট্যাকা পাওয়া তো দূরের কতা। সরকার হামার ছোলটার খোঁজই দিব্যার পায় নাই।’

একই গ্রামের (ভাঙ্গামোড়) দিনমজুর ওয়াহেদ আলী রানা প্লাজা ধসের ১৬ দিন পরে ছেলে সবুজ মিয়ার (১৮) দেহাবশেষ পেয়েছিলেন। তাঁদের বাড়িতে কেউ গেলেই সবুজ মিয়ার মা মনজিলা বেগম এখনো ছেলেকে ফিরে চান। বাবা ওয়াহেদ আলী বলেন, প্রত্যেক নিহত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের সরকার চাকরি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখনো সে আশ্বাস পূরণ হয়নি। কষ্টে কাটছে তাঁদের দিন।

একই উপজেলার কিশমত হলদিয়া গ্রামের স্মৃতি রানীর (২৫) পরিবারের অবস্থাও করুণ। মা সন্ধ্যা রানী রীতিমতো খাবারের কষ্টে আছেন। তিনি বললেন, স্মৃতির টাকা দিয়ে সংসার চলত। তাঁর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এখন সংসারে চরম টানাটানি।

নিহত স্মৃতির বড় বোন মাধবী রানী বলেন, ‘আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকার চেক দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, নিহত পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেল, চাকরি দূরের কথা, কেউ খোঁজও নেয়নি।’

গত সোমবার বিকেলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিস আলী ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলোর বিষয়ে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর তাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।