আবজাল দম্পতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে

আবজাল হোসেন
আবজাল হোসেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে অবশেষে মামলা হচ্ছে।

আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘ হলেও প্রথম মামলাটি হচ্ছে ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতি কেনার নামে ওই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কাল শুক্রবার মামলা করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

আজ বৃহস্পতিবার কমিশন ওই মামলার অনুমোদন দেয় বলে জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।

মামলার অন্য আট আসামি হলেন—স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সুবাস চন্দ্র সাহা, সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, কলেজের হিসাবরক্ষক হুররমা আক্তার খুকী, কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া, একই দপ্তরের সাবেক এসএএস সুপার সুরজিত রায় দাশ, পংকজ কুমার বৈদ্য এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক উচ্চমান সহকারী খায়রুল আলম।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আবজাল দম্পতির দুর্নীতির এই অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল। তাদের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন মামলার অনুমোদন দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই সাবেক অধ্যক্ষ রেজাউল করিম যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেন। এ জন্য তিনি ক্রয়সংক্রান্ত কাজ করার জন্য কমিটি গঠনের অনুমতি চেয়ে চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদকে চিঠি দেন। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার আগেই অধ্যক্ষ বিভিন্ন কমিটি গঠন করেন। চিঠি দিয়ে বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র চান। পরে বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র না পেয়েও তিনি পছন্দের ঠিকাদার রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে কার্যাদেশ দেন।

রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা শুরু করেন। আবজালের সঙ্গে বিয়ের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তাঁরা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রুবিনা খানম কার্যাদেশ অনুসারে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে ভুয়া ও ব্যবহার–অনুপযোগী যন্ত্রপাতি বিভিন্ন দেশের লেবেল লাগিয়ে কক্সবাজার মেডিকেলে সরবরাহ করেন। পরে ৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিল জমা দিয়ে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। ওই সব যন্ত্রপাতি এখনো ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে।

দুদক বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর আবদুর রশীদ অবৈধ ওই কর্মকাণ্ড বন্ধ না করে চাহিদাপত্র না পাওয়া সত্ত্বেও আর্থিক ক্ষমতার বাইরে ভেঙে ভেঙে প্রথমে ৩০ কোটি ও পরে সাড়ে সাত কোটি টাকা রহমান ট্রেডকে দিয়ে দেন। এর মাধ্যমে তিনি রুবিনাকে ওই টাকা আত্মসাতে সহায়তা করেন।

অন্য কর্মকর্তারাও অবৈধ এই কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়। তাই তাঁদের আসামি করা হচ্ছে।

দুদক জানিয়েছে, আবজালের বিরুদ্ধে প্রথম এই মামলা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে, তাতে মামলার সংখ্যা হবে অনেক। ওই সব অভিযোগের অনুসন্ধান প্রতিবেদন পেলে মামলা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়েন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে এ বছরের ৬ জানুয়ারি আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি দেয়ে দুদক। আবজালকে দুদকে ডেকে ১০ জানুয়ারি দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের অনুসন্ধান দল। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জানুয়ারি আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক, অর্থাৎ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত।

তবে খবর পাওয়া গেছে, আবজাল দম্পতি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

গত ১৩ মার্চ দুদকের উপপরিচালক ও আবজালের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে আবজাল ও তাঁর স্ত্রীর পাসপোর্ট নম্বর, এনআইডি নম্বর দিয়ে তাঁদের বিদেশ যাওয়া-আসার তথ্য চাওয়া হয়েছে। ৬ জানুয়ারি দেওয়া চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়, ওই চিঠিতে এই দম্পতির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁরা দেশ ছেড়ে গেছেন। এ বিষয়ে দ্রুত দুদককে তথ্য জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।