লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে

কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ। এই সুযোগে  মালিকেরা লঞ্চগুলোকে ডাঙায় তুলে লঞ্চের মেরামতের কাজ সেরে ফেলছেন। রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজার পোড়া পাহাড় এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে। ছবি: সুপ্রিয় চাকমা
কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ। এই সুযোগে মালিকেরা লঞ্চগুলোকে ডাঙায় তুলে লঞ্চের মেরামতের কাজ সেরে ফেলছেন। রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজার পোড়া পাহাড় এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে। ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

কাপ্তাই লেকের পানি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। জেগে উঠেছে চর। আর এর ফলে রাঙামাটির জেলা শহরের সঙ্গে ৭ উপজেলার লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে যাতায়াতের চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে ৬ উপজেলার সাড়ে ৪ লাখের বেশি মানুষ। একই কারণে পণ্য পরিবহনেও ভোগান্তি বাড়ছে। সম্প্রতি তীব্র দাবদাহ ও লেকে তলদেশ ভরাট হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 

লেকের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে গেছে। লেকের মৎস্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়েছে।
রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি জেলা সদর থেকে ৬ উপজেলায় নৌযোগাযোগ স্থাপন সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় মাছের অভয়াশ্রম স্থল। সম্প্রতি লেক ভরাট হয়ে যাওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মাছের উৎপাদনে হুমকি হয়ে উঠেছে। বহুমাতৃক সুবিধা সৃষ্টি হওয়া এই লেকটির এখন ধীরে ধীরে সক্ষমতা কমে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ায় তলদেশ ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে জেগে উঠছে অসংখ্য চর। ইতিমধ্যে রাঙামাটির সঙ্গে ৬ উপজেলার লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বছরে ৪ মাস লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা সদরের সঙ্গে লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও নানিয়ারচরের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। তবে কাপ্তাই উপজেলা সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা থাকলেও নৌপথে যাতায়াত করা যায়। অন্য উপজেলার মধ্যে নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার খাগড়াছড়ি জেলা ঘুরে বিকল্প সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। তবে সময় বেশি লাগে, খরচও বেশি। বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।

গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাঙামাটি-বাঘাইছড়ি নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এপ্রিল মাসের শুরুতে সরাসরি রাঙামাটি-জুরাছড়ি উপজেলার সঙ্গে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি বরকল, নানিয়ারচর, কাপ্তাই ও বিলাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল লংগদু উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন লোকজন।
জুরাছড়ি উপজেলার চিত্ত কুমার চাকমা বলছিলেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ায় কিছু ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও হেঁটে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এ ছাড়া পানি শুকিয়ে যাওয়ায় উপজেলায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
লঞ্চচালক মো. শফি প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকা শত শত শ্রমিক বেকার সময় পার করছেন। আগামী জুনের আগে কাপ্তাই লেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে।
রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই লেকে ৭ উপজেলায় ৫০টি লঞ্চ চলাচল করে। এসব লঞ্চে ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক রয়েছেন। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাঁরা বেকার সময় পার করছেন। বিভিন্ন উপজেলা নৌপথগুলো নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় নৌচলাচল ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে: কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। এই পাঁচ ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। কাপ্তাই জলবিদ্যুকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তীব্র দাবদাহে কাপ্তাই লেকের পানি ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে কাপ্তাই লেক। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে কাপ্তাই লেকের পানির লেভেল (স্তর) ৭৮ দশমিক ৯৯ ফুট এম এস এল ( মিন সি লেভেল)। কাপ্তাই লেকের রুল কার্ভ ( সময়ভিত্তিক পানি ওঠা–নামার মাপ) অনুযায়ী থাকার কথা ছিল ৮৩ দশমিক ৪০ ফুট।

মো. শামসুদ্দিন বলেন, এখন পাঁচটির মধ্যে দুই ইউনিট চালু রয়েছে। তবে যেভাবে পানি কমে যাচ্ছে তাতে কিছু দিনের মধ্যে একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাবে।

মাছের উৎপাদন হুমকি: কর্ণফুলী, মাইন ও কাচালংসহ পাঁচটি নদীর পাহাড়ি ঢলে অব্যাহতভাবে পলি জমে কাপ্তাই লেক ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মাছের অভয়াশ্রম কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে গভীর পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। লেকে ৭৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৭টি দেশীয় ও ৮টি বিদেশি মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে ছয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ছয় প্রজাতির মাছে এখন বিলুপ্তপ্রায়। অন্যান্য প্রজাতির মাছের মধ্যে বেশি করে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ প্রজাতির মাছ।
রাঙামাটি মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করা না হলে মাছের উৎপাদন কমে আসবে। ইতিমধ্যে কয়েক প্রজাতির গভীর পানির মাছ হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বেশ কিছু গভীর পানির মাছ হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। চলতি মৌসুমে শুধু অগভীর পানির মাছ আহরণ করে ১১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করা হলে মাছের উৎপাদন বাড়বে, ফলে রাজস্ব দ্বিগুণ বাড়বে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ এবং ইনষ্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) কাপ্তাই লেকের অংশ থেগামুখ পর্যন্ত সমীক্ষা করেছে। ড্রেজিং করা হলে নৌযোগাযোগ ও মাছের প্রজনন বাড়বে বলে তিনি জানান।