জাহিদুরের পথে হাঁটবেন বিএনপির অন্য সাংসদেরা?

শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্ত না মেনে বিএনপির ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির অন্য সাংসদরাও কী তাহলে নির্ধারিত ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শপথ নেবেন।

নির্বাচিত সাংসদদের সূত্রগুলো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচিতদের অনেকেই শপথ নিতে আগ্রহী। দল তাঁদের শপথ না নেওয়ার কথা বললেও, তাঁরা এখনো দলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর বিএনপি বলছে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা এই হুমকিতে বিশেষ ভয় পাচ্ছেন না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরও ৫ বিএনপি সাংসদ এখনো শপথ নেননি।

তবে সাংসদ জাহিদুরকে অনুসরণ করতে পারেন বিএনপির অন্য সাংসদেরা। বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সবার তো এক থাকারই কথা ছিল। দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। এখনো তো সময় আছে।’

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত আমিনুল ইসলাম। শপথ প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। মন-মেজাজ খুব খারাপ। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। কিছুই বুঝছি না। দেখা যাক কী হয়।’

দল শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; নতুন করে আর কোনো সিদ্ধান্ত নেবে কিনা জানতে চাইলে শপথ নিতে আগ্রহীরা বলেন, রাজনীতিতে একদম শেষ মুহূর্তে গিয়েও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ তাঁরা আশা করছেন, দল শেষ পর্যন্ত শপথের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেবে।

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা সাংগঠনিক অপরাধ। সিদ্ধান্ত অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তিনি জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপিসহ অনেক দলই। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় সব দলই অংশ নেয়। একতরফা এই নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জেতে আওয়ামী লীগ। অনিয়মের অভিযোগ তুলে এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি করে আসছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিভিন্ন দল। এই নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে জয়ী হন আটজন। কিন্তু জিতলেও জোটের কেউ শপথ নেবে না বলেও জানান হয়েছিল। তবে নির্বাচিতদের অনেকে শুরু থেকেই শপথের পক্ষে ছিলেন। ফলে জোটের সিদ্ধান্ত আর টেকেনি। জোটের সিদ্ধান্ত না মেনে প্রথম শপথ নেন গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর (মৌলভীবাজার-২)। পরে শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেন মোকাব্বির খান (সিলেট-২)।

গতকাল সকালে জাহিদুর রহমান শপথ নেওয়ার বিষয়ে তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেন। দুপুরেই স্পিকার তাঁর শপথ পড়ান। গত ১৫ এপ্রিল বিএনপির পাঁচ নির্বাচিত সদস্য দলের গুলশান অফিসে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তাঁরা শপথের বিষয়ে দলের অবস্থান জানতে চান এবং নিজেদের আগ্রহের কথা জানান। অবশ্য তাঁরা সেদিন জানিয়েছিলেন, দল শপথের বিপক্ষে। এরপরে বিএনপির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলছেন, কেউই শপথ নেবেন না।

বিএনপির থেকে জানানো হয়, জাহিদুর রহমান যে শপথ নেবেন তা দলের কাউকে জানাননি। তাঁর সঙ্গের অন্যরা বলছেন, তাঁরা সবাই শপথের সিদ্ধান্তে একমতেই ছিলেন, জাহিদুর কাউকে না জানিয়েই শপথ নিয়েছেন।

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেওয়ায় দল বহিষ্কার করলে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সাংসদ জাহিদুর শঙ্কিত নন বলে জানান। শপথ নেওয়ার পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল বহিষ্কার করলে করুক। আমি তো আর দলকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি দলের সঙ্গেই থাকব। ৩৮ বছর ধরেই তো আছি। সুতরাং আমি এই দলেরই লোক।’

শপথ নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি শপথ নেওয়া উচিত। কারণ আমাদের নেত্রী কারাগারে। তিনি অসুস্থ। দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে, তারা জেলে আছে। বাইরে থেকে কিছুই হচ্ছে না। সুতরাং বাইরে থেকে লাভ কী? তার চেয়ে ভেতরেই যাই, অন্তত চিৎকার করে কথা তো বলতে পারব।’

সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের প্রথম বৈঠকের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শপথগ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সদস্যপদ বাতিল করে আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসে এ বছরের ৩০ জানুয়ারি। এই হিসেবে ২৯ এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচিত সদস্যদের শপথগ্রহণ করতে হবে।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যেসব সাংসদ শপথগ্রহণ করেছেন, আইন অনুযায়ী তাঁদের সদস্যপদ থাকবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সাংসদ নির্বাচনের পর সাংসদ পদে থাকার অযোগ্য হবেন কি না কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সাংসদের আসন শূন্য হবে কি না—এ সম্পর্কিত কোনো বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তবে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।

এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগও তাঁদের নেই। তবে তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাঁদের বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে হলে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে।