ঘোষণার পর বাঘ এল, ফসকেও গেল

>
  • ১০ বছর পর বাঘ ধরতে কেওড় দেওয়া হলো
  • বাঘ ফাঁকা জায়গা দেখে পালাতে গিয়ে জালে ধরা পড়ে
  • অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জাল ফাঁদা হয়

‘প্রিয় এলাকাবাসী, এলাকায় বাঘ নেমেছে। আপনারা জাল নিয়ে তৈরি থাকেন, আজ বাঘ কেওড় (আটক) হবে।’ মাইকে এ রকম ঘোষণার পর সকাল থেকে গ্রামে চলে প্রস্তুতি। দুপুরের দিকে ‘কেওড়’ তৈরি করা হয়। বিকেলে জানানো হয়, কেওড়বন্দী বাঘ। এ খবর শুনে আশপাশের গ্রামের মানুষজনও সেখানে জড়ো হন। সন্ধ্যার দিকে কেওড় ভেদ করে পালায় বাঘটি।

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের লোভাছড়া চা–বাগানের নুনুছড়া এলাকার ‘বাঘ টিলা’ নামক স্থানে জ্যান্ত বাঘ ধরতে গত বুধবার এভাবেই ‘বাঘ কেওড়’ দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। দিনভর চেষ্টার পর সন্ধ্যায় বাঘটি কেওড় ভেদ করে পালানোয় বিফল হয় গ্রামবাসীর চেষ্টা। বাঘ ধরার চেষ্টায় গ্রামবাসীসহ কেওড় কমিটির নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

বাঘ ধরতে বাঘ কেওড় দেওয়ার ঘটনাটি ঘটল প্রায় এক দশক পর। ২০০৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রামবাসী এভাবে কেওড় দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন বিপন্নপ্রায় ব্ল্যাক প্যান্থার প্রজাতির একটি কালো বাঘ। হত্যা নয়, কৌশল করে জীবিত অবস্থায় বাঘ ধরতে গ্রামবাসীর এই সচেতনতায় দুই শতাধিক বাঘকে কেওড় দেওয়া হয়েছিল। এতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে বনের বাঘ বনে ফিরে গেছে। আর যে পাঁচটি বাঘ ধরা পড়েছে, তার মধ্যে একটি চিতাবাঘ চট্টগ্রামের সাফারি পার্কে সংরক্ষিত আছে, যার নাম ‘জৈন্তিয়া’। এ নিয়ে ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর ‘বাঘের মায়ায় এককাট্টা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

লোকালয়ে বাঘ এসে ঢুকলে তাকে ধরতে সম্ভাব্য বিচরণস্থলের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় তিন দিক থেকে মানুষের বেষ্টনী তৈরি করা হয়। উন্মুক্ত থাকে যে দিক, সেখানে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জাল ফাঁদা হয়। বেষ্টনীস্থল থেকে লোকজন হাঁকডাক দেন; কখনো ঢোল পেটানো হয়। বনের বাঘ ফাঁকা জায়গা দেখে পালাতে গিয়ে জালে ধরা পড়ে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় বাঘ কেওড়।

ঐতিহাসিক তথ্যমতে, জৈন্তা রাজ্যের একটি পরগনা হচ্ছে সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলার নুনাছড়া এলাকা। তখন জনবসতিগুলো ছিল পাহাড়-টিলা আর ঝোপঝাড়বেষ্টিত। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে ওই সব জনবসতিতে বাঘ আসত। রাজা বাঘটিকে গুলি করে হত্যার ফরমান জারি করতেন। বাঘ হত্যার ‘বীরত্ব’ তখন ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজ্যময় প্রচার করা হতো। রাজার রাজত্ব শেষ হলেও বাঘ হত্যার সেই বীরত্ব বংশপরম্পরায় ধরে রাখার প্রবণতা ছিল স্থানীয় মানুষের মধ্যে। রাজার যুগে চারটি পরগনা এখন নয়টি গ্রাম। শুষ্ক মৌসুমের এ সময়ে সীমান্তের ওপার থেকে বাঘ এপারে নুনাছড়া এলাকায় চলে আসত। লোকালয়ে নামামাত্র সাড়ম্বরে বাঘ হত্যার আয়োজন করা হতো। এ জন্য গঠন করা হয়েছিল ‘বাঘ হত্যা কমিটি’। বাঘ হত্যাযজ্ঞ হয়েছে সেই রাজার যুগের মতোই ঢাকঢোল পিটিয়ে।

বাঘ হত্যার ওই সব ঘটনায় গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে মামলা হয়। এরপরই বোধোদয় ঘটে গ্রামের লোকজনের। ‘বাঘ হত্যা কমিটি’ বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় ‘বাঘ কেওড় কমিটি’। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ চৌধুরী। ২০০৯ সালের পর বুধবারই প্রথম বাঘ কেওড় দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমদ চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বিভিন্ন সময় খাবারের সন্ধানে দলছুট হয়ে বাঘ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের বন ও টিলাবেষ্টিত এলাকায় চলে আসে। ২২ এপ্রিল রাতে একটি বড় ডোরাকাটা বাঘ (স্থানীয়ভাবে বড় বাঘা নামে পরিচিত) টিলায় অবস্থান নেয়। বাঘটি একজন কৃষকের একটি গরু খেয়ে ফেলে। এলাকার গবাদিপশুকে বাঘের হাত থেকে রক্ষায় বাঘটিকে জীবিত ধরার চেষ্টা চালান তাঁরা। এ জন্য বুধবার সকাল থেকে নয়টি গ্রামের লোকজন একত্র হয়ে কেওড় দেওয়া হয়। বাঘটি কেওড়বন্দী হলেও জাল টপকে পাশের টিলা হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়।

গ্রামবাসীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বছরের শুষ্ক মৌসুমে বাগফৌজ, কালীনগর, লক্ষ্মীপ্রসাদ, পাটানিপাড়া, বউলবাগ, তৃতীয় বউলবাগ, বিহারীপাড়া, পশ্চিম বিহারীপাড়া, নয়াখেল এলাকায় বাঘের বিচরণ দেখা দেয়। এই ৯টি গ্রামের ১৮টি মহল্লায় প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস। বাঘ কেওড় কমিটির সভাপতি ফারুক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘বাঘ কেওড় মানে বাঘকে প্রাণে হত্যা নয়, আমরা বাঘকে জীবিত ধরে বন বিভাগে হস্তান্তর করতেই এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম।’

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বনজঙ্গল থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের এপারে নয়টি গ্রাম বাঘের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত বলে বন বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে। ২০০৯ সালে ওই এলাকা থেকেই কালো বাঘ জ্যান্ত অবস্থায় বাঘ কেওড় কমিটির মাধ্যমে ধরা পড়েছিল। তবে বন বিভাগে হস্তান্তর করার পর শেষ পর্যন্ত বাঘটি আর বাঁচেনি বলে বন বিভাগ সূত্র জানায়।

প্রায় ১০ বছর পর আবার বাঘ কেওড় সম্পর্কে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম সাজ্জাদ হোসেন গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকায় বাঘের বিচরণ বিষয়ে স্থানীয় বন বিভাগের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কেওড় কমিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে এ কারণে যে ধরতে পারলে বাঘটি যেন মারা না হয়।