চার ভ্রমণকন্যা কক্সবাজারে

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে চার ভ্রমণকন্যা। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে চার ভ্রমণকন্যা। ছবি: প্রথম আলো

 এক স্কুটিতে দুই তরুণী। দুটিতে চেপেছেন চারজন। পরনে জাতীয় পতাকার আদলে ‘লাল-সবুজ’ গেঞ্জি। বুকে লেখা ‘বাংলাদেশ’, পিঠে লেখা ‘ভ্রমণকন্যা’। প্রচণ্ড গরম কিংবা ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে ভ্রমণকন্যারা স্কুটি নিয়ে ছুটছেন শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে দুর্গম কোনো উপকূলে।

ভ্রমণকন্যাদের উদ্দেশ্য পর্যটনশিল্পের প্রসারের পাশাপাশি নারীদের ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলা। মাদক, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, আত্মরক্ষার কৌশল, বয়ঃসন্ধিসহ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মেয়েদের সচেতন ও সতর্ক করা। ইতিমধ্যে দেশের ৫৮টি জেলায় প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার সড়কপথে স্কুটি চালিয়েছেন এই তরুণীরা। আগামী ৫ মে ৬৪তম জেলা হিসেবে ঢাকায় পৌঁছে পুরো বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার ‘মাইলফলক’ স্পর্শ করবেন তাঁরা। সম্প্রতি ৫৯তম জেলা হিসেবে কক্সবাজারে এসেছিলেন ভ্রমণকন্যারা।

ভ্রমণকন্যাদের মধ্যে স্কুটি চালান দুজন—সাকিয়া হক ও মানসী সাহা। সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করেছেন তাঁরা। অপর দুজনের মধ্যে সিলভী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুনতাহা রুম্মান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ স্লোগানে চার তরুণী ঘুরছেন সারা দেশ। তাঁরা জানান, স্কুটি দুটি পেয়েছেন কর্ণফুলী স্কুটির সৌজন্যে। তাঁদের ভ্রমণ পরিকল্পনা শুনেই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে আসে। স্কুটি পাওয়ার পর সাকিয়া ও মানসী চালানো শেখেন।

২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর যাত্রা শুরু হয় ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ নামে এক ফেসবুক গ্রুপের। গ্রুপের সদস্যরা সবাই নারী। শুরুতে গ্রুপের সদস্য ছিল ২০ থেকে ২৫ জন। এখন তা ২৫ হাজারের বেশি। ফেসবুকের গণ্ডি ছাপিয়ে গ্রুপটি রূপ নেয় সংগঠনে। বর্তমানে ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ সংগঠনের সভাপতি ডা. সাকিয়া হক, সাধারণ সম্পাদক ডা. মানসী সাহা। সংগঠনের উদ্যোগে বের হয় ভ্রমণবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ভ্রমণকন্যা’। সংগঠনটি এ বছর সিআরআইয়ের জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লম্বরি মালকা বানু উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চার ভ্রমণকন্যা। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লম্বরি মালকা বানু উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চার ভ্রমণকন্যা। ছবি: প্রথম আলো

৫৯তম জেলা হিসেবে কক্সবাজার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সাকিয়া হক। তিনি বলেন, সমুদ্র উপকূলের লোকজনকে দেখলে বোঝা যায় তাঁরা খুব সহজ-সরল। তবে তাঁরা সব সময় মাদক নিয়ে আতঙ্কে থাকেন। লোকজনের ভাষ্য, মেরিন ড্রাইভ দিয়ে রাতের বেলায় ইয়াবা পাচার হয়। বন্দুকযুদ্ধে বহু ইয়াবা পাচারকারী মারাও গেছে। ভয়ে লোকজন মেরিন ড্রাইভে ওঠেন না। তরুণীরা পথে পথে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন, মাদক নিয়ে তাঁদের সচেতন করেন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা নিয়ে দেন উপদেশ।

‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গে মানসী সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে মেয়েদের সাইকেল চালানোর বিষয়টি এখনো সেভাবে প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। অথচ দেশের বাইরে মেয়েরা স্কুটি চালিয়ে স্কুল-কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে। আমরা এ ক্ষেত্রে দেশের মেয়েদের উৎসাহিত করছি। সাড়াও পাচ্ছি বেশ। আমাদের স্কুটিভ্রমণ মানুষের নজরও কাড়ছে।’

এই যাত্রায় তাঁরা হাজির হচ্ছেন প্রতিটি জেলার অন্তত একটি স্কুলে। সেখানে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন সমস্যা, স্বাস্থ্যসচেতন, আত্মরক্ষার কৌশল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভ্রমণসহ নানা বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। আবার নিজেদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও শোনান তরুণীরা। ভ্রমণকন্যারা এবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লম্বরি মালকা বানু উচ্চবিদ্যালয়ের যান।

মানসী সাহা বলেন, ঘুরতে ঘুরতে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যার অধিকাংশই ইতিবাচক। চারজন মেয়ে স্কুটি চালাচ্ছেন দেখে পথে অনেকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। আবার অনেকেই বাহবা দেন তাঁদের সাহস ও উদ্যোগের জন্য। দিনভর ঘুরে রাতে থাকেন পরিচিত কারও বাসা কিংবা সরকারি বাংলোয়।

১৩ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন, হাত-পা ভাঙেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে মানসী সাহা একগাল হেসে বলেন, ‘চার-পাঁচবার দুর্ঘটনায় পড়েছি। হাত ভাঙেনি, তবে চারবার পা মচকে গেছে। পেশায় চিকিৎসক তো, তাই তেমন সমস্যা হয়নি। পুরো ভ্রমণকালে কারও অসুখ–বিসুখও হয়নি। তবে কয়েকবার স্কুটির চাকা পাংচার হয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছিল।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ভ্রমণকন্যারা কথা বলছেন। ছবি: প্রথম আলো
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ভ্রমণকন্যারা কথা বলছেন। ছবি: প্রথম আলো

স্বপ্নের বাংলাদেশ
স্কুটিতে চড়ে তরুণীদের সারা দেশ ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যই ছিল সুন্দরকে খুঁজে আনা। প্রিয় বাংলাদেশকে নারীরা কীভাবে দেখেন, আর দেশের মানুষ কীভাবে দেখেন নারীদের, শহর-বন্দর-গ্রাম–গঞ্জ ঘুরে তা জানতে চেয়েছেন ভ্রমণকন্যারা। এতে তাঁরা সফলও হয়েছেন। বাংলাদেশ খুব সুন্দর। প্রতিটি জেলায় কিছু না কিছু আছে, সেগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষণ আছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি, খাবারদাবার। মানুষগুলোও একেক রকম। খাবারের ধরন আলাদা। এক জায়গায় বসে এসব টের পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের অফুরান সম্পদ কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থনীতির চাকা সমৃদ্ধ হতো।

২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে তাঁদের বাংলাদেশ ভ্রমণ শুরু হয়। ইতিমধ্যে তাঁরা সাতটি ধাপে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, দিনাজপুর, বগুড়া, শ্রীমঙ্গল, সুনামগঞ্জসহ ৫৮টি জেলায় ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন। গতকাল শনিবার তাঁরা কক্সবাজার ছেড়েছেন। সেখান থেকে ৬০ তম জেলা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গিয়েছিলেন। আজ রোববার যাবেন বান্দরবান। সেখান থেকে ২৯ এপ্রিল যাবেন রাঙামাটি, ৩০ এপ্রিল খাগড়াছড়ি। আগামী ৫ মে ৬৪তম জেলা হিসেবে ঢাকায় শেষ হবে দুই বছরের এই বাংলাদেশ ভ্রমণ।

পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে সাকিয়া হক বললেন, ‘কখনো বসে থাকব না। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ৬৪ জেলায় মানবসেবার সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চলবে।’

‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ সংগঠনটির ভ্রমণের ব্যাপারে কড়াকড়ি নিয়ম হলো, কোথাও ঘুরতে গিয়ে পরিবেশ নোংরা করা যাবে না। ময়লা–আবর্জনা ফেলা যাবে না। ময়লা–আবর্জনার জন্য সদস্যরা সঙ্গে নিয়ে যান বিন ব্যাগ। উদ্দেশ্য-বাংলাদেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা। বাংলাদেশ সুন্দর হলে মানুষের মনও সুন্দর হবে।