বাবুল চিশতীর বিরুদ্ধে পঞ্চম মামলা

মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় রাজধানীর গুলশান থানায় আজ সোমবার করা এ মামলায় চিশতীসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচটি মামলা হলো। সবগুলো মামলাতেই মাহবুবুল হক চিশতীকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম মামলা করার পর থেকে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন চিশতী।

শেরপুরের মেসার্স রোজবার্গ অটো রাইস মিলের মালিকের সঙ্গে যোগসাজশে ফারমার্স ব্যাংকের প্রায় ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নতুন মামলাটি হয়। চিশতী ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন মেসার্স রোজবার্গ অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হযরত আলী, পরিচালক দেলোয়ার হোসেন, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এক্সিকিউটিভ অফিসার ও শেরপুর শাখার প্রধান উত্তম বড়ুয়া, ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম, ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব করপোরেট ব্যাংকিং ডিভিশন, যমুনা ব্যাংক) ফয়সাল আহসান চৌধুরী ও সিটি সার্ভে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল আলম।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে ঋণের নামে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ নিয়েছেন। বন্ধকি সম্পত্তির অতি মূল্যায়ন দেখিয়ে নেওয়া ৫৮ কোটি (যা সুদাসলে ৬৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা) আত্মসাৎ করেছেন। পরে ওই অর্থের অবৈধ প্রকৃতি গোপন করার জন্য জ্ঞাতসারে স্থানান্তর, হস্তান্তরপূর্বক লেয়ারিং করে অপরাধ করেছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের শেরপুর শাখার এর ঋণ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স রোজবার্গ অটো রাইস মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হযরত আলী ও পরিচালক দেলোয়ার হোসেন। হযরত আলী ২০১৪ সালের ২৬ জুন ব্যাংকটির শেরপুর শাখায় একটি হিসাব খোলেন। শেরপুর শাখা থেকে ওই গ্রাহকের জন্য মোট ৬০ কোটি টাকার কম্পোজিট ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠান ব্যাংকটির শাখাপ্রধান উত্তম বড়ুয়া। প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল আহসান চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত এমডি এ কে এম শামীমের যৌথ স্বাক্ষরে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৫৮ কোটি (সিসি-হাইপো ৪০ কোটি এবং টার্ম ঋণ-১৮ কোটি) টাকার কম্পোজিট ঋণসীমার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট এডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে ঋণ মঞ্জুরিপত্র ইস্যু করা হয়। অথচ ওই সময়ে গ্রাহকের সিআইবি ছিল এসএমএ যা শ্রেণীকৃত হিসাবের পর্যায়ে পড়ে। এ ছাড়া গ্রাহকের দায়গুলোর বিষয়ে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। তা ছাড়া গ্রাহকের লেনদেন সন্তোষজনক ছিল না। শাখায় একজন নতুন গ্রাহককে ঋণের নামে বর্ণিত আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণের অর্থ আত্মসাতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, সিটি সার্ভে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল আলম স্বাক্ষরিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে মেসার্স রোজবার্গ অটো রাইস মিলসের দেওয়া ৩টি তফসিলে বর্ণিত সম্পত্তির মোট মূল্য ৭৬ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা ও তাৎক্ষণিক বিক্রয়মূল্য ৬০ কোটি ৯৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ফারমার্স ব্যাংকের শেরপুর শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মনিরুল হকসহ ৪ সদস্যবিশিষ্ট দলের প্রতিবেদনে ওই সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য ৬ কোটি ৭০ লাখ এবং তাৎক্ষণিক বিক্রয়মূল্য ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা উল্লেখ কর হয়েছে। সিটি সার্ভে লিমিটেড ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধকি সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন দেখিয়ে অবৈধ ঋণ বিতরণে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, প্রধান কার্যালয়ের ইস্যু করা মঞ্জুরিপত্র মোতাবেক কোনো শর্ত পালন ছাড়াই মঞ্জুরীকৃত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক উত্তম বড়ুয়া ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ঋণ বিতরণ করে ওই অর্থ আত্মসাতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। সর্বশেষ শেরপুর শাখা থেকে ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে সিসি-হাইপো ঋণ প্রস্তাব নবায়নের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। পরের মাসে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে টাকার সিসি-হাইপো ঋণসীমার নবায়ন প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মঞ্জুরিপত্রের শর্ত না মেনে ঋণসুবিধা নবায়ন করা হয়েছে। শাখার পাঠানো ঋণ প্রস্তাবে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়/রাজস্ব, আয় এবং নিট লাভ, প্রকল্পের প্রাক্কলিত খরচের হিসাব না করা, সহায়ক জামানতের প্রকৃত মূল্য যাচাই-বাছাই না করা, গ্রাহকের প্রকৃত আর্থিক সামর্থ্য এবং প্রয়োজন বিবেচনা না করে ৫৮ কোটি টাকা বিতরণের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এজাহারে আরও বলা হয়, রোজবার্গ অটো রাইস মিলসের অনুকূলে ৫৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রাহকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সহায়ক জামানত সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়নি। কোনোরূপ যথাযথ নিয়ম পালন ছাড়াই ব্যাংকের তৎকালীন এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) পরিচালনা পর্ষদের প্রভাব খাটিয়ে ঋণ মঞ্জুরির ব্যবস্থা নিয়েছেন।

ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান যে ১৫৩ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত সে জমি ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধক এবং অপরিবর্তনীয় আমমোক্তারনামা করা হয়নি। ওই জমি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় হযরত আলীর ঋণ হিসাবের বিপরীতে বন্ধক আছে বলে ব্যাংকটি জানিয়েছে। ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধক এবং অপরিবর্তনীয় আমমোক্তারনামা না করেই ফারমার্স ব্যাংকের শেরপুর শাখা কৃষি ব্যাংকের অনুকূলে ৩৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫ হাজার ৮৪৫ টাকার দায় পরিশোধ করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ওই শাখা থেকে কোনো অনাপত্তিপত্রও নেওয়া হয়নি।

দুদকের সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রোজবার্গ অটো রাইস মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হযরত আলী, পরিচালক দেলোয়ার হোসেনকে ওই অর্থ আত্মসাতে মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, শাখা ব্যবস্থাপক উত্তম বড়ুয়া, ভারপ্রাপ্ত এমডি এ কে এম এম শামীম, ঋণ প্রশাসন বিভাগের ফয়সাল আহসান চৌধুরী ও সার্ভেয়ার খায়রুল আলম প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন।
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করছে দুদক। উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান দলের পক্ষ থেকে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক মামলাটি করেছেন।

ফারমার্স ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলাও হয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল করা মামলায় অভিযোগপত্রও দিয়েছে সংস্থাটি। মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী) পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। চিশতী ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ফারমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত এসভিপি জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও চাকরিচ্যুত ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান। মামলার এজাহারে ৬ জনকে আসামি করা হলেও তদন্তে ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাঁকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে নথিপত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক যাত্রা শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকটে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে পদ ছাড়তে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী।