চক্রের স্বার্থে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নুসরাত

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান
>

• অধ্যক্ষ সিরাজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন
• শ্লীলতাহানির মামলায় ২৭ মার্চ গ্রেপ্তার হন সিরাজ
• নুসরাতের ওপর অগ্নিসন্ত্রাসের মামলায় ৯ এপ্রিল গ্রেপ্তার
• বিশেষ কায়দায় নুসরাতকে হত্যার কথা বলেন অধ্যক্ষ

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে খুনের পরিকল্পনা হয় ৩ এপ্রিল। ওই দিন মাদ্রাসার ছাত্ররা কারাগারে গেলে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা বিষয়টি ‘সর্বশক্তি দিয়ে’ দেখতে বলেন। কারণ, নুসরাত তাঁদের সবার সম্মিলিত স্বার্থে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্ররাও অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তে রাজি হন।

গত রোববার ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৬৪ ধারায় ১৯ পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন। গত ২৭ মার্চ দুপুরে সোনাগাজী মাদ্রাসা থেকে শ্লীলতাহানির মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন। আর ৯ এপ্রিল নুসরাতের ওপর অগ্নিসন্ত্রাসের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আদালতে সিরাজ বলেন, ৩ এপ্রিল ফেনীর কারাগারে তাঁর সঙ্গে ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, আবদুল কাদের, জাবেদ হোসেনসহ কয়েকজন দেখা করেন।

ছাত্ররা তাঁকে জানান, জামিন এত তাড়াতাড়ি হবে না। নুসরাতের পরিবারের বিষয়ে কী করা হচ্ছে তা তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেন। ওই দিন কারাগারে শাহাদাত ও নুর উদ্দিনের সঙ্গে অধ্যক্ষ আলাদাভাবে কথা বলেন। শাহাদাত ও নুর উদ্দিনকে অধ্যক্ষ জানান যে সর্বশক্তি দিয়ে বিষয়টি দেখতে, নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে। এতে কাজ না হলে পরিকল্পনা করে নুসরাতকে হত্যা করতে। বিশেষ কায়দায় হত্যা করার কথা বলেন তিনি, যাতে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। তিনি ছাত্রদের বলেন, প্রয়োজনে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলম তাঁদের সহায়তা করবেন।

আদালতে অধ্যক্ষ বলেন, ‘শাহাদাত ও নুর উদ্দিন আমার পরিকল্পনার সঙ্গে একমত পোষণ করে। তারপর তারা চলে যায়। তবে নুসরাত আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের সামনে এসে যাওয়ায় হত্যার বিষয়ে ছাত্রদের জানাই।’

জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ বলেন, ২০০১ সালে তিনি সোনাগাজী মাদ্রাসায় যোগ দেওয়ার পর প্রভাব বিস্তার করতে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে একধরনের বলয় তৈরির কথা স্বীকার করেন অধ্যক্ষ। এভাবে স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক হয়।

অধ্যক্ষ জানান, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মাদ্রাসার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেন এবং তা বাস্তবায়ন করতেন। ফলে মাদ্রাসায় তাঁর প্রভাব বাড়ে বলে আদালতে জানান।

জবানবন্দিতে সিরাজ আরও বলেছেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি কিছু ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে ‘মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি’ শাহাদাত হোসেন শামীম, ‘মাদ্রাসা শাখা ছাত্রদলের সভাপতি’ নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের, জাবেদ, জুবায়েরকে অধ্যক্ষ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতেন। তাঁদের পরীক্ষা ফি ও বেতন মওকুফ ছাড়াও পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেওয়া ও তাঁদের পছন্দের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং আয়ের কমিশন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন অধ্যক্ষ।

২৭ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ সিরাজ দাবি করেন, ‘ওই দিন সকালে অফিস সহকারী নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাতকে ডাকি। নুসরাত আরও তিনজন ছাত্রীসহ আসে। আমার কাছে খবর ছিল, অন্য ছেলের সঙ্গে নুসরাতের সম্পর্ক আছে। তাই আমি তাকে চাপ প্রয়োগ করতে ডাকি। আমার কক্ষে আসার পর নুসরাতের সঙ্গে কিছু কথা হয়। তারপর সে পড়ে গেলে আমি পেছন থেকে তার কোমরে দুই হাত দিই। সে সেখানে (মেঝেতে) বসে থাকে। পরে নুসরাত চলে যায়।’

সিরাজ দাবি করেন, ‘ওই দিন দুপুরে নুসরাতের মা এসে আমাকে মারার চেষ্টা করে। আমি একপর্যায়ে তাদের হুমকি দিই। সেখানে নুর উদ্দিন উপস্থিত ছিল। পরে শাহাদাতও আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে রুহুল আমিনকে ফোন করি এবং তিনি থানা থেকে এসআই ইকবালকে পাঠান। তারপর ইকবাল নুসরাতকে ডেকে আনেন। এরপর পুলিশ আমাকেসহ থানায় নিয়ে যায়।’