শ্রমিকের অধিকার সীমিতই থাকছে

নৌযান মেরামত কারখানার উঁচু জাহাজে ঝুঁকি নিয়ে ঘষামাজা ও রং করার কাজ করছেন এই নারী শ্রমিকেরা। দিনে মজুরি পান জনপ্রতি ২৩৫ টাকা। গতকাল দুপুরে খুলনার কাস্টম ঘাটে।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
নৌযান মেরামত কারখানার উঁচু জাহাজে ঝুঁকি নিয়ে ঘষামাজা ও রং করার কাজ করছেন এই নারী শ্রমিকেরা। দিনে মজুরি পান জনপ্রতি ২৩৫ টাকা। গতকাল দুপুরে খুলনার কাস্টম ঘাটে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

রানা প্লাজা ধসের পর দেশি-বিদেশি চাপের মুখে গত ছয় বছরে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় শ্রম আইন সংশোধন, কর্মপরিবেশের উন্নয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে শ্রমিক সংঘ বা ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বৃদ্ধি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দর-কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি হলেও শ্রম অধিকার আদায়ের সুযোগ সীমিত হয়েছে। ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামলে হামলা, মামলা ও ছাঁটাইয়ের শিকারও হচ্ছেন শ্রমিকেরা।

শ্রমিকনেতারা বলছেন, ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়লেও তার অধিকাংশই কাগজ-কলমে। সংশোধিত শ্রম আইনের কোথাও কোথাও অস্পষ্টতা আছে। বঞ্চিত শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা দেখভালের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের অভাবের পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনের সক্রিয় উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া অধিকার আদায়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো সংগঠিত নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্তর্জাতিক ব্যবসা হওয়ার কারণে পোশাক খাতের শ্রম অধিকার নিয়েই বেশি কথাবার্তা হয়। অন্য খাতের বিষয়ে আলোচনা কম। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের আগে তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ১৩২।

নানামুখী চাপের কারণে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যাটি বেড়ে হয়েছে ৭৩৩। সংখ্যার দিক থেকে গত ছয় বছরে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েছে ৬০০। অন্যদিকে শ্রম আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে অধিকাংশ কারখানায় ওয়ার্কার পার্টিসিপেশন কমিটি (ডব্লিউপিসি) হয়েছে।

শ্রমিকদের অধিকার কেন এখনো নিশ্চিত হলো না জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে শ্রমিকেরা যেসব সুবিধা পেয়েছেন, তা আর কখনো পাননি। তাই তাঁদের অধিকার নিশ্চিত হয়নি এটা সঠিক নয়। পোশাক খাতেও কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণে ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এ ফান্ড থেকে অসুস্থ শ্রমিক ও শ্রমিকের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সহায়তা পাচ্ছেন। পোশাকশ্রমিকের মজুরি বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকদের মতো সুরক্ষার জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরপরও কারও সমস্যা হলে আমাদের কাছে আসার দরজা খোলা আছে।’

 তবে শ্রমিকনেতারা বলছেন, পোশাক খাতে সংখ্যার দিক থেকে ট্রেড ইউনিয়ন বাড়লেও তা যে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় ভূমিকা তেমন রাখছে না, সেটা গত বছরের ডিসেম্বর আর এ বছরের জানুয়ারিতে শ্রমিক চাকরিচ্যুতির ঘটনয় থেকে স্পষ্ট। মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের সেই আন্দোলন দমাতে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই এবং কয়েক হাজার পোশাকশ্রমিকের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা দায়ের করা হয়। তার মধ্যে ৩৩টি মামলা করেছেন মালিকেরা। তা ছাড়া বিজিএমইএর তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে আন্দোলন করা অনেক শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এতে অন্য কোনো কারখানায় কাজ পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা। কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন গত ৫ মার্চ শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের বিষয়ে সুরাহার জন্য একটি স্মারকলিপি দেন।

জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার বলেন, শ্রম আইন মানতে ও ক্রেতাদের দেখানোর জন্য কাগজে-কলমে মালিকেরা ডব্লিউপিসি করেছেন। যেসব কারখানায় ইউনিয়ন হয়েছে তার মধ্যে ছোট-মাঝারি কারখানা বর্তমানে বন্ধ। কিছু ইউনিয়ন মালিকপক্ষ নিজেদের স্বার্থে, আবার কিছু ফেডারেশন ও মালিকেরা মিলে এবং সরকারের শ্রম দপ্তর ও ফেডারেশন মিলেও কিছু ইউনিয়ন নিবন্ধন হয়েছে। এসবের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের সংশ্লিষ্টতা নেই। সব মিলিয়ে বর্তমানে ৪০-৪৫টি ইউনিয়ন সক্রিয় আছে। সত্যিকারের ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা কম থাকার কারণেই শ্রম অধিকারের বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে না।

শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রেড ইউনিয়নের পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনগুলো সক্রিয় ভূমিকা রাখলে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির পরিস্থিতি এড়ানো যেত। তবে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির পর তাঁদের কাজ ফিরে পাওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ আদায়ে বেশি ব্যস্ত থাকে শ্রমিক সংগঠনগুলো। ফলে চাকরি হারানো শ্রমিকও কাজ ফিরে পাওয়ার চেয়ে ছাড় দিয়ে হলেও তাঁর পাওনা বুঝে নিতে বাধ্য হন।

 শ্রমিক ফেডারেশনগুলো জোরালো ভূমিকা না রাখার বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় চাকরিচ্যুত শ্রমিকের মামলা বেশ কয়েক বছর ধরে শ্রম আদালতে বিচারাধীন থাকে। এটি বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকও পাওনা বুঝে নিতে আগ্রহী থাকেন। তা ছাড়া দীর্ঘ একটা সময় ধরে ওই শ্রমিক নির্দিষ্ট এক জায়গায় অনেক সময় থাকেন না। শ্রমিকের মানসিকতা আর বিদ্যমান ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় আমরা চাকরিচ্যুত শ্রমিকের পাওনা বুঝে নেওয়ার বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে বাধ্য হই।’