ধর্ষণের বিচার হয় না, সালিস হয়

চরওয়াপদায় বিলের ওপর কোনোরকমে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটাই ওদের। আসা-যাওয়ার পথে যে তরুণ উত্ত্যক্ত করতেন রোজ, তিনিই মাস তিনেক আগে এক রাতে ঘরের ভেতরে ঢুকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করেন। বিচার চাইতে গিয়ে কিশোরী মেয়েটার জীবন এখন সমাজ, থানা আর আদালতের চক্করে আটকা পড়েছে।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় দু-এক দিন ঘুরলেই এমন অনেক বিবরণ শোনা যায়। উপজেলার পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে যৌন নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। এমনিতে আলোচনায় কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনা আসলে অনেক ঘটে।

থানার আনুষ্ঠানিক হিসাবের দৌড় গত বছর হওয়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌনপীড়নের আটটি মামলা এবং এ বছরের চারটি মামলা পর্যন্ত। গত বছরের সাতটি মামলায় অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর তদন্ত শেষ হয়নি। ওই একই সময়ে অপরাধগুলোয় জেলার দুটি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে সরাসরি ৩৭টি মামলা হয়েছে।

তিন দিন ধরে উপজেলা সদর আর প্রত্যন্ত কিছু এলাকা ঘোরার সময় এ প্রতিবেদকেরা কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা নারী অধিকার সংগঠনের তৎপরতার খোঁজ পাননি। জনপ্রতিনিধিরা খোলাখুলি সালিস-বিচারের কথা বলেছেন।

আইনজীবী রবিউল হাসান
এ ধরনের মামলায় আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সুবর্ণচরে আসলে একটা বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই যত ঘটনা ঘটছে, মামলা তত হচ্ছে না। আবার মামলা হলেও মাঝপথে আপস হয়ে যাচ্ছে।

মেঘনা নদীর এই চরে নারী নির্যাতনের বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে গত জাতীয় নির্বাচনের সময় থেকে ঘটে যাওয়া পরপর চারটি ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ৫৭৬ বর্গকিলোমিটারের এই চরে শুধু বাজারলাগোয়া এলাকাগুলোয় কিছুটা ঘনবসতি। আর জনপদ বলতে তরমুজ, সয়াবিন, ডাল ও ধানখেতের মাঝখানে দু-চারটি করে বাড়ি।

সুবর্ণচর উপজেলার আটটি ইউনিয়নই চর। উপজেলা সদর চরজব্বারে। তার কাছাকাছি চরজুবিলী। চরমোহাম্মদপুর ও চরওয়াপদা অনেক দূরে।

গত ২৫, ২৬ ও ২৭ এপ্রিল এই চার ইউনিয়নের অন্তত ১২টি জনবসতিতে কমপক্ষে ৫০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, এ অঞ্চলে পুরুষদের বড় অংশ বছরের আট মাস চট্টগ্রাম বা কুমিল্লার ইটভাটায় কাজ করেন। বিরান চরে বাড়িতে নারীরা অরক্ষিত থাকেন। জনপ্রতিনিধি, পুলিশ বা প্রশাসনের কোনো নজর নেই। বরং নির্যাতক ও বখাটেদের সঙ্গে তাঁদের আপস-আঁতাত হয়ে যায়।

চরওয়াপদার সেই কিশোরী এমন এক ফাঁকা গ্রামের বাসিন্দা। বাবা চট্টগ্রামের ইটভাটায় কাজ করেন। ছন আর ত্রিপল দিয়ে ঘেরা ঘরটিতে মা আর ছোট পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে সে থাকে। একই উঠানে আরও তিন শরিকের ঘর।

গত ২৬ এপ্রিল উঠানে দাঁড়িয়ে মেয়েটির মা প্রথম আলোকে বলেন, ওই রাতে প্রতিবেশীর এক ছেলে হঠাৎ ঘরে ঢুকে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে। সাড়া পেয়ে চার ঘরের মেয়েরা আর দুই বয়স্ক পুরুষ ছেলেটিকে চেপে ধরেন। তখন পরনের লুঙ্গি ফেলে তরুণটি পালিয়ে যায়।

তখন ‘সমাজ’ অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আর প্রভাবশালী লোকজন সিদ্ধান্ত দেন, তরুণটির সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দিতে হবে। মেয়ের পরিবার লুঙ্গি নিয়ে ছুটে যায় ছেলের অভিভাবকের কাছে। ছেলেপক্ষ টালবাহানা করতে থাকলে ১৫ দিনের মাথায় সমাজের পরামর্শে মেয়েটি আদালতে মামলা করে।

তখন ছেলেটি বিয়ে করে। তবে শর্ত ছিল দেড় শ লোককে দাওয়াত খাওয়াতে হবে। মেয়েটির অতিদরিদ্র পরিবার তা করতে পারেনি। ছেলেপক্ষও মেয়েটিকে ঘরে তোলেনি। পুলিশ সম্প্রতি জানতে পেরেছে, ছেলেটি এখন এলাকায় নেই।

মামলা করার সময় মেয়েটির বয়স দেখানো হয়েছে ১৮। তাকে দেখতে ১৪-১৫ বছরের মনে হয়। সে এখন ছাপা শাড়ি পরে, মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘরে বসে থাকে। তার কপালে কী আছে, সে জানে না।

তদন্তে গেলে মেয়েটির পরিবার পুলিশ কর্মকর্তাকে টাকা সেধেছিল। কর্মকর্তাটি প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেছেন যে এরা এতই গরিব যে এদের বরং টাকা দিয়ে আসতে মন চায়। এদিকে চার ইউনিয়নেই গ্রামবাসী বলেছে, পুলিশ মামলার তদন্তে গেলে হাজার তিনেক টাকা দিতে লাগে। মানুষ চাঁদা তুলেও তা দেয়।

কেউ কেন থানায় যায় না

সুবর্ণচরে বসতি গড়ার ইতিহাস আর দশটা চরের মতোই। এখানে নোয়াখালী ও হাতিয়া এবং লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও ভোলা থেকে লোকজন নিয়ে এসে যাঁরা চর দখল করেছেন, তাঁরাই ক্ষমতাশালী। যাঁর দখল যত বড়, তাঁর তত ক্ষমতা।

এলাকার লোকজন বলেন, মূলত এই পরিবারগুলোর সদস্যরাই ইউপির চেয়ারম্যান-মেম্বার, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। এঁরাই বিচার-আচার করেন, এঁরাই ধর্ষণ-যৌনপীড়নের সালিস বসান। এঁরাই সাজা দেন, জরিমানা করেন। সালিসের আগে দুই পক্ষের কাছ থেকে জামানত রাখেন। সেটার একটা অংশ সালিসকারীরা নিয়ে নেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানের ঘটনাগুলোতে এমন প্রভাবশালী পরিবার বলতে চরজব্বারে ‘ধন কাজী’দের নাম এসেছে। আর এসেছে সুবর্ণচরে গত ডিসেম্বরে নির্বাচনের রাতে ধর্ষণের ঘটনার পরিকল্পনার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের নেতা রুহুল আমিনের পরিবার ও দলবলের নাম। দুই গোষ্ঠীরই কয়েকজন করে সম্প্রতি ধর্ষণ মামলায় কারাগারে আছেন।

গত ২ মার্চ চরমোহাম্মদপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। তাঁর শ্বশুর সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এক ব্যক্তি ঘরে ঢুকে পুত্রবধূর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন। সালিসে অভিযুক্তকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে ‘সমাজ’। ওই সালিসের প্রধান ছিলেন স্থানীয় ইউপির সদস্য নূর উদ্দীন। সালিসের পর গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন।

তখন শ্বশুর মামলা করলে পুলিশ আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ইতিমধ্যে গত ১৬ এপ্রিল হাইকোর্ট এ মামলার নিরিখে রুল দিয়ে জানতে চান, ধর্ষণ–জাতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে সালিসি বৈঠক কেন আইনগত কর্তৃত্ব–বহির্ভূত হবে না। এর পরপর সালিসকারী নূর উদ্দীন গ্রেপ্তার হন।

থানায় এবং শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটির চরিত্রকে কটাক্ষ করে কথাবার্তা কানে আসে। শাশুড়ি রেশমা আক্তার প্রথম আলোকে আরও বলেন, জরিমানার টাকার একটা অংশ তাঁরা পেতেন। কিন্তু তার আগেই পুত্রবধূ আত্মহত্যা করেছেন।

আইনত, ফৌজদারি অপরাধে সালিস করা যায় না। তবে সুবর্ণচরে সালিস থেমে নেই। চরকাজী ওয়াজেদের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সমাজের ক্ষমতাধর মানুষের কাছে চরের মানুষ এক রকম জিম্মি। সালিসের রায় বেশির ভাগ সময় অপরাধীর পক্ষে যায় বা তাকে ছাড় দেয়। ধর্ষকের সঙ্গে বাল্যবিবাহ হয়, বহুবিবাহ হয়। তালাক ও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করে না।

সুবর্ণচরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সব খবর পান না। চলতি বছর চরমোহাম্মদপুরে গৃহবধূকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, চরবাটায় স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ এবং চরজব্বারে ছয় সন্তানের মাকে গণধর্ষণের মামলাগুলোর পর উপজেলা প্রশাসন জরুরি সভা ডাকে।

জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়, তাঁরা যেন নিজ নিজ এলাকার খোঁজখবর রাখেন এবং এখতিয়ার-বহির্ভূত সালিস না করেন। ইউএনওর অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিরা কোনো খবর দেন না। একই অভিযোগ করেন এই উপজেলার একমাত্র থানা চরজব্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহেদ উদ্দীন।

চরজব্বার ইউপির চেয়ারম্যান তরিকউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজে এখতিয়ারের বাইরে যান না। তবে চরাঞ্চলে এ ধরনের বিচার-আচার বরাবরই হয়ে আসছে। ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, যৌনপীড়ন বা হয়রানির মতো ঘটনার বিচার যে সালিসে হচ্ছে না, তা বলা যাবে না।

থানায় হয়রানির অভিযোগ

প্রথম আলোর দেখা গ্রামগুলোতে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেছে, সমাজপতি আর অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক আছে। নারী নির্যাতনের ঘটনাকে পুলিশ গুরুত্ব দেয় না।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে চরজব্বার থানায় বসে থাকার সময় প্রতিবেদকের কানে আসে, নালিশ নিয়ে আসা কেউ বলছেন, ‘কোনো টিঁয়া (টাকা) দিয়ার পারতাম না।’

গত জাতীয় নির্বাচনের রাতে চরজুবিলীতে ঘটা গণধর্ষণের মামলাটিতে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে, তখনকার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ওই নারী প্রথম আলোকে বলেছেন, সে রাতে হামলাকারীরা তাঁরই বাড়ির আরেক কিশোরী মেয়েকে নির্যাতন করতে গিয়েছিল। তাঁর ছেলে হাতে–পায়ে ধরে মেয়েটিকে বাঁচান। কিন্তু এই ঘটনায় তাঁরা আলাদা কোনো মামলা করেননি। অভিযুক্ত আসামিদের সঙ্গে নির্বাচনের আগে পুলিশের মাখামাখি ছিল প্রকাশ্য।

চরজব্বারে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় গত ৩১ মার্চ ছয় সন্তানের মাকে ধর্ষণের ঘটনায় ধন কাজীদের আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রধান আসামি আবুল কালাম, আবুল বাশার ও মো. ইউসুফ মাঝির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও নারী নির্যাতনের মামলা রয়েছে।

এই মামলায় ভুক্তভোগী নারীর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত রয়েছে। তাঁর পরনের কাপড়ে ধর্ষকদের ডিএনএর খোঁজে সিআইডির ল্যাবে পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই থানার একাধিক সূত্র নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোর কাছে সন্দেহ জানিয়ে বলেছে যে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা হয়তো দায়ী নন।

ভুক্তভোগী নারী গত ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী চরজব্বার থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ পাত্তা দেয়নি। হাসপাতালে তিনি পুলিশ সুপারকে সব খুলে বলায় মামলা হয়। স্ত্রী যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তাঁর স্বামী কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হওয়ায় আমার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ের বিয়েটা ভেঙে গেছে। কোনো কারণে যদি ওদের বিচার না হয়, পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের এলাকাছাড়া হতে হবে। পুলিশ শুধু অন্য লাইনে নিতে চায়।’

পুলিশ অবশ্য বলেছে, নারী নির্যাতনের মামলায় তারা কোনো ছাড় দেয় না। নির্বাচন-পরবর্তী চারটি ধর্ষণের ঘটনাতেই তারা আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে।

তবে নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, থানা পর্যন্ত যেতে যে শক্তি, সামর্থ্য ও অর্থ দরকার, তার কোনোটাই চরের নারীদের নেই। নিরুপায় এ নারীদের মনে বল-ভরসাও নেই। চরজব্বারে ধর্ষণের শিকার ও নিখোঁজ এক নারীর মা যেমন বললেন, ‘আল্লাহ যদি থামায় তো থাইমব (যৌন নির্যাতন)। নাইলে থাইম তো ন।’