বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৫টি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশ ঝড়ের দেশ, জলোচ্ছ্বাসের দেশ। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় এই বঙ্গ ভূখণ্ডে ঘটে গেছে ভয়ংকরতম কিছু ঘূর্ণিঝড়। বর্তমান বাংলাদেশ ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত থাকলেও এ ঘূর্ণিঝড়গুলো এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল। মানুষের মৃত্যুর তথ্য বিবেচনা করে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে মৃত মানুষের সংখ্যার কিছু হেরফের হতে পারে।
১. ভোলা সাইক্লোন
১২-১৩ নভেম্বর, ১৯৭০
মৃতের সংখ্যা: সরকারি হিসাবে ৩ লাখ। বেসরকারি হিসাবে ৫ লাখ।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় এটি। সাধারণত ১৯৭০ সালের এই ঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে পরিচিত। এটি ছিল সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছিল ৮ নভেম্বর। ধীরে ধীরে এটি শক্তিশালী হয় এবং উত্তর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার বা ১১৫ মাইল। জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মিটার। এই গতিতেই এটি উপকূলে আঘাত করে। এই ঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিন, চর তজুমদ্দিন, মাইজদী ও হরিণঘাটায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। তজুমদ্দিনের তখনকার জনসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারের মধ্যে ৭৭ হাজার জন প্রাণ হারায় সে ঝড়ে।
ভোলা সাইক্লোনে মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবমতে, এই সাইক্লোনে মারা যায় প্রায় ৩ লাখ মানুষ। আর বেসরকারি মতে এ সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখ। এ ছাড়া ভোলা সাইক্লোনে ৩৮ হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী এবং ৭৭ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ২০ হাজারের বেশি মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। ১০ লাখের বেশি গবাদিপশুর মৃত্যু, প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি এবং ৩ হাজার ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. ১৫৮২ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৫৮২ সাল
মৃতের সংখ্যা: ২ লাখ
আইন-ই-আকবরি, রিয়াস-উস-সালাতিন এবং বিভিন্ন প্রাচীন নথিপত্রের সূত্র উল্লেখ করে সার্ক প্রকাশিত (১৯৯৮) একটি গবেষণা জানাচ্ছে, ১৫৮২ সালে বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না।
৩. গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন
৩১ অক্টোবর-১ নভেম্বর, ১৮৭৬
মৃতের সংখ্যা: ২ লাখ
বর্তমান বরিশাল জেলার একটি উপজেলা হিসেবে পরিচিত হলেও বাকেরগঞ্জ ছিল ব্রিটিশ আমলের একটি জেলা। এই বাকেরগঞ্জ এবং সংলগ্ন অঞ্চলে ১৮৭৬ সালে একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাপিডিয়া এই ঝড়ের তারিখ উল্লেখ করেছে ৩১ অক্টোবর এবং সার্ক (১৯৯৮) প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই ঝড়ের তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১ নভেম্বর। মানুষ ও গবাদিপশুর মৃত্যুর হার, ফসল এবং অন্যান্য সম্পদহানির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে এই ঝড়কে বলা হয় ‘গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’।
৪. ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঝড়
২৫-৩০ এপ্রিল, ১৯৯১
মৃতের সংখ্যা: প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার
১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ০২বি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে। ২৯ এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত করে। স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ৩০ এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়। এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ১০২টি উপজেলা। তবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা, টেকনাফ। ১৯৯১ সালের এই ঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মৃত্যুবরণ করে এবং প্রায় সমপরিমাণ মানুষ আহত হয়।
৫. ১৮২২ সালের ঘূর্ণিঝড়
জুন, ১৮২২
মৃতের সংখ্যা: ৫০ হাজার
ঘূর্ণিঝড়টি সংঘটিত হয়েছিল ১৮২২ সালের জুন মাসে। বরিশাল-বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে হয়ে যাওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া প্রায় ১ লাখ গবাদিপশু মারা যায় এ ঝড়ে।
৬. ১৭৬৭ সালের ঘূর্ণিঝড়
মৃতের সংখ্যা: ৩০ হাজার
বরিশাল-বাকেরগঞ্জের উপকূলীয় অঞ্চলে একটি ঘূর্ণিঝড়ে ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল বলে জানা যায়। এ ঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৩ দশমিক ৩ মিটার বা ৪৩ ফুট।
৭. ১৮৩১ সালের ঘূর্ণিঝড়
৩১ অক্টোবর, ১৮৩১
মৃতের সংখ্যা: ২২ হাজার
এ ঝড়ে ভারতের ওডিশা উপকূলও প্লাবিত হয়। জলোচ্ছ্বাসে সৃষ্টি হওয়া ঢেউয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৫ ফুট। বাংলা ও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায় এ ঝড়ে মৃত্যুবরণ করে ২২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া এতে ৫০ হাজার গবাদিপশুর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়।
৮. ১৯৬৩ সালের ঘূর্ণিঝড়
২৮-২৯ মে, ১৯৬৩
মৃতের সংখ্যা: সরকারি হিসাবে ১১ হাজার ৫২০। বেসরকারি হিসাবে ২২ হাজার
এ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছিল চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ এবং নোয়াখালী জেলায়। এর উৎপত্তি হয়েছিল উত্তর আন্দামান সাগরে। এটি ২৮ মে রাতে সীতাকুণ্ড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর সর্বোচ্চ বাতাসের গতিবেগ রেকর্ড করা হয় ঘণ্টায় ১৬৭ কিলোমিটার। ঢেউয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ২০ ফুট।
৯. ১৯৬৫ সালের ঘূর্ণিঝড়
৯-১২ মে, ১৯৬৫
মৃতের সংখ্যা: ১৯ হাজার ২৭৯
এ ঝড় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে ১১ মে মধ্যরাতে বরিশাল ও নোয়াখালী দিয়ে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। এ ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২ ফুট। এতে বরিশাল, নোয়াখালী, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১০. ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৪-৩০ নভেম্বর, ১৯৮৮
মৃতের সংখ্যা: ১১ হাজার ৬৮৩ জন
এ ঝড় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে খুলনার কাছে রায়মঙ্গল নদের কাছ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এটি যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশালের বিভিন্ন চর এবং উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বাতাসের বেগ ছিল সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল সাড়ে ১৪ ফুট।
১১. ১৯৬১ সালের ঘূর্ণিঝড়
৫-৯ মে, ১৯৬১
মৃতের সংখ্যা: ১১ হাজার ৪৬৮
এ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল মূলত ঢাকা, কুমিল্লা ও সংলগ্ন এলাকায়। এ ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। এটি মেঘনার পশ্চিম মোহনা অতিক্রম করে সকাল নয়টায়। এ ঝড়ে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ কাঁচা ঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
১২. উড়িরচর সাইক্লোন
২২-২৫ মে, ১৯৮৫
মৃতের সংখ্যা: ১১ হাজার ৬৯
এই ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলবর্তী দ্বীপ সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং উড়িরচরে। বাতাসের গতিবেগ ছিল চট্টগ্রামে ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার, সন্দ্বীপে ১৩৯ কিলোমিটার, কক্সবাজারে ১০৪ কিলোমিটার। সেই সঙ্গে ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এতে ১১ হাজার ৬৯ জন নিহত হয় এবং ৯৪ হাজার ৩৭৯টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩টি পশুসম্পদ বিনষ্ট হয়। মোট ৭৪ কিলোমিটার সড়ক ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৩. সিডর
১৫ নভেম্বর, ২০০৭
মৃতের সংখ্যা: ১০ হাজার (রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি)
সরকারি হিসাব: ৬ হাজার
বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিডর। এটি ০৬বি টাইপ ঘূর্ণিঝড়। এ ঝড়ে বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। এ কারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী এটি ক্যাটাগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত। খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকা লন্ডভন্ড করে দেওয়া ঘূর্ণিঝড়টির সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট।
১৪. ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়
৩০-৩১ অক্টোবর, ১৯৬০
মৃতের সংখ্যা: ৫,১৪৯
চট্টগ্রামে এ ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯৩ কিলোমিটার। তবে চট্টগ্রামের বহির্নোঙরে থাকা এস এস বালি নামে সুইডেনের একটি জাহাজ প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ২০৯ কিলোমিটার রেকর্ড করেছিল বলে জানা যায়। ৩১ তারিখ এই ঝড় বরিশাল অতিক্রম করে ১৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে। এ ঝড়ের কারণে সৃষ্ট ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ২২ ফুট।
১৫. ১৯৪১ সালের ঘূর্ণিঝড়
২২-২৬ মে, ১৯৪১
মৃতের সংখ্যা: ৫,০০০
ভোলা, বরিশাল ও নোয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল এ ঘূর্ণিঝড়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভোলা অঞ্চল। এ ঝড়ে সৃষ্টি হওয়া জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১০-১২ ফুট।
সূত্র: ১. দ্য ইমপ্যাক্ট অব ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস অন দ্য কোস্টাল রিজিয়ন অব সার্ক কান্ট্রিজ অ্যান্ড দেয়ার ইনফ্লুয়েন্স ইন দ্য রিজিয়ন, সার্ক মেটেরোলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার (এসএমআরসি), ১৯৯৮, আগারগাঁও, ঢাকা।