ফণীর স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি ছিল সবচেয়ে বেশি

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে হেলে পড়ছে গাছগুলো। গতকাল চট্টগ্রামের পতেঙ্গার জেলেপাড়ায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে হেলে পড়ছে গাছগুলো। গতকাল চট্টগ্রামের পতেঙ্গার জেলেপাড়ায়। ছবি: সৌরভ দাশ
>

• দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে আগেও অনেক ঝড় দেশে প্রবেশ করেছে
• আগের ঝড়গুলোর বিস্তৃতি ছিল দেশের ৫০-৬০ ভাগ এলাকায়
• ঘূর্ণিঝড় ফণী একপর্যায়ে দেশের প্রায় পুরো ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়
• ফণী প্রায় ১২ ঘণ্টা দেশে ঘূর্ণিঝড়-নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করে

ঘূর্ণিঝড় ফণী দুর্বল অবস্থায় ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতির শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও বড় আকারের এই ঝড়ের কেন্দ্রের একাংশ ছিল বঙ্গোপসাগরে। আরেকাংশ ছিল যশোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে। গতকাল শনিবার ভোর ছয়টায় বাংলাদেশ উপকূলে ঘূর্ণিঝড়টির মূল অংশটি প্রবেশ করে, একপর্যায়ে তা দেশের প্রায় পুরো ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়। এতে ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেছে, প্রবল বৃষ্টিও ঝরেছে। বিগত ৫২ বছরে দেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে ফণীর স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি ছিল সবচেয়ে বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ঘূর্ণিঝড়বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে এর আগেও অনেক ঝড় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু অন্যগুলোর সঙ্গে ফণীর পার্থক্য হচ্ছে, আগের ঝড়গুলোর বিস্তৃতি ছিল বড়জোর দেশের ৫০ থেকে ৬০ ভাগ এলাকায়। এগুলোর স্থায়িত্বকাল ছিল ২ থেকে ৫ ঘণ্টা। কিন্তু ফণী প্রায় ১২ ঘণ্টা বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ফণী আমাদের একটি বড় শিক্ষা দিয়েছে। তা হচ্ছে শুধু উপকূল নয়, দেশের মধ্যাঞ্চল, উত্তর ও উত্তর–পূর্ব দিকেও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও সুন্দরবন থাকায় আগের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ফণী সুন্দরবনকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা বাইরে দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। এর ফলে এটি কোথাও বাধা পায়নি। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়টির স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশে ছিল।’

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ফণীর প্রভাবে পাবনা, রাজশাহী থেকে শুরু করে চাঁদপুর ও নোয়াখালীতে ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে গেছে। গতকাল দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে চাঁদপুরে ১২৮ ও নোয়াখালীর মাইজদীতে ১২১ মিলিমিটার। অন্যদিকে বাতাসের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি ছিল চট্টগ্রামে, ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। এ ছাড়া রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় ফণীর প্রভাবে ৪০ থেকে ৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে।

২০১৭ সালের নভেম্বরে বিশ্বব্যাংকের করা গবেষণা ‘বাংলাদেশে ঝড় থেকে সুরক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৭৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মোট ৪৮টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৬৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আঘাত করেছে ২০টি ঘূর্ণিঝড়। এসব ঝড়ের সব কটি সরাসরি উপকূল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যার বেশির ভাগই ছিল খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও বাগেরহাট অঞ্চল দিয়ে।

এসব ঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ। এর আওতায় সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন। যাঁরা ঝড়ের সময় মানুষের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেন, মাইকিং করেন, ঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। দেশের উপকূলের ৪৩টি উপজেলায় তাঁদের কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য অঞ্চলে এর আগে তেমন কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়নি বা বড় প্রভাব পড়েনি বলে সেখানে তেমন কোনো প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম নেই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিপিপির পরিচালক ও যুগ্ম সচিব আহমাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির কার্যক্রম আগে ১৩টি উপকূলীয় জেলায় ছিল। আমরা সম্প্রতি তা ১৯টি জেলায় বিস্তৃত করেছি। ঘূর্ণিঝড় ফণী আমাদের শিক্ষা দিল। সিপিপির কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতি কমানোর ক্ষেত্রে সুন্দরবন বড় ভূমিকা রেখেছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় যাওয়ার সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪ থেকে সাড়ে ১৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমে গেছে। বিশেষ করে ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসের গতি সুন্দরবনের কারণে অর্ধেকে নেমে আসে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের সব কার্যক্রম উপকূলকেন্দ্রিক। আর ফণী যে এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অর্থাৎ যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় একসময় সুন্দরবন ছিল, সেই বন নানা কারণে ধ্বংস করে বসতি তৈরি হয়েছে। ফলে ফণী থেকে আমরা শিক্ষা পেলাম, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বেড়িবাঁধগুলো মেরামত করা ও উচ্চতা বাড়ানোর পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা করতে হবে।’