অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জমিদারবাড়ি

বাকেরগঞ্জে রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর জমিদারবাড়ি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা।  প্রথম আলো
বাকেরগঞ্জে রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর জমিদারবাড়ি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। প্রথম আলো

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর (নাটুবাবু) জমিদারবাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্থানীয় একটি চক্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এবং এর আশপাশের জমি দীর্ঘদিন ধরে দখল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করেছে পুলিশ।

জমিদারের উত্তরাধিকারেরা বলছেন, ঐতিহাসিক এই বাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করুক এবং এর সম্পত্তি সরকার জনকল্যাণে ব্যবহার করুক।

মুক্তিযুদ্ধে জমিদারবাড়িটি বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর এই বাড়ি ও জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ২৫ মার্চের পর বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল জমিদার বাড়িটি। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা হতো। উনিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জমিদারির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন পঞ্চম বংশধর কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী (নাটুবাবু)। তিনি ছিলেন আজীবন বিপ্লবী। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প তৈরি করে এখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতাবিরোধীরা কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীকে হত্যা করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ৬ দশমিক ৬৯ একর জমির ওপর গড়ে তোলা বাড়িটির মূল দোতলা ভবনটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বাড়িতে ঢোকার মূল ফটকও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দোতলা মূল ভবনটিতে বাস করছেন কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর স্ত্রী ছায়া রায় চৌধুরী ও ছেলে বিপ্লব বন্ধু রায় চৌধুরী। বাড়ির ভেতরে বড় একটি দিঘি, একটি পুকুর ও বাগান রয়েছে। এই পরিবারের জমির ওপর শ্যামপুর মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্যামপুর বাজার, মসজিদ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

বাকেরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে ভুলু বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া তৎকালীন ছাত্রনেতা ও বর্তমানে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি খান আলতাফ হোসেন (ভুলু) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিদার কুমুদ বন্ধু রায় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তাঁদের বাড়িটি ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধার খাবার থেকে শুরু করে আবাসনের সব ব্যবস্থাই করেছিলেন কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী। যুদ্ধকালীন সময়ে ১৫ নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন সম্মুখযুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। ওই যুদ্ধে ৩৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারেরা।

পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে জমিদার বাড়ির অনেক স্থাপনা।  ছবি: প্রথম আলো
পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে জমিদার বাড়ির অনেক স্থাপনা। ছবি: প্রথম আলো

কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী স্ত্রী ছায়া রায় চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অন্ধকার নেমে আসে জমিদার পরিবারে। মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেন স্বাধীনতাবিরোধীরা। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হন স্থানীয় রাজনীতিতে। এরপর থেকে নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন তাঁদের পরিবারের ওপর, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান রয়েছে।

কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর ছেলে লন্ডনপ্রবাসী বিপ্লব বন্ধু রায় চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে আদৌ সংরক্ষিত হয়নি মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই জমিদারবাড়ি। বাড়িটি দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও তাঁদের সহযোগীরা। এ ঘটনায় তিনি (বিপ্লব) বাদী হয়ে সম্প্রতি বাকেরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

বিপ্লব বন্ধু রায় চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমরা চাই, বাড়িটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রের কোনো সেবামূলক কাজে ব্যবহার করুক। আমরা সব সম্পত্তি সেবামূলক কাজে দান করে দিতেও প্রস্তুত।’

বরিশালের পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জিডি করার পর দখল করা জমি উদ্ধার করা হয়েছে। বাড়িটি সংরক্ষণে যা যা করা প্রয়োজন, তা করা হবে। পরিবারটির নিরাপত্তার বিষয়টিও সুনিশ্চিত করা হয়েছে।