ভুক্তভোগী নারীর সুরক্ষায় জোর দিতে হবে

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন রাজনীতিবিদ ও সাবেক সাংসদ মাহজাবিন খালেদ। পাশে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন রাজনীতিবিদ ও সাবেক সাংসদ মাহজাবিন খালেদ। পাশে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। ছবি: প্রথম আলো

ঘরে কিংবা বাইরে—সব জায়গাতেই নারীকে সহিংসতার মুখে পড়তে হয় এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। সহিংসতা ভয়াবহ আকার না নিলে ভুক্তভোগী নারী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনি সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকেন। উল্টো প্রতিবাদ করতে গিয়ে নতুন করে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তাঁরা। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

নারীকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার প্রদান ও ক্ষমতায়নে রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দুর্বৃত্তরা নারী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। দলীয় প্রভাব ছাড়া সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ায় গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করে আলোচকেরা বলেন, নারীকে অবদমনের একটি বড় হাতিয়ার তাঁর প্রতি সহিংসতা। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে। নির্বাচন করায় নারীকে তালাক দেওয়া হচ্ছে, চরিত্রহীন বলা হচ্ছে। এসব যতটা না প্রতিপক্ষের হাতে, তার চেয়ে বেশি ঘটছে আন্তদলের মধ্যে। সহিংসতা বন্ধ করতে আইনের প্রয়োগ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার বলে জানান তাঁরা।

বর্তমান পরিস্থিতিকে নারীর জন্য দুর্যোগকালীন অবস্থা উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, শান্তিপূর্ণ সময় বা নির্বাচনকালীন যা–ই হোক না কেন, নারীকে অবদমনের বড় হাতিয়ার শারীরিক নির্যাতন। নুসরাতসহ সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শুধু এপ্রিল মাসেই ৪০১ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৬ জন।

বৈঠকে ‘নারীর প্রতি নির্বাচনকালীন সহিংসতা’ শিরোনামে একটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইআইডির জ্যেষ্ঠ সহযোগী গবেষক ফাল্গুনী রেজা। গবেষণার তথ্য বলছে, নয়জনের মধ্যে ছয়জন নারীকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়। তাঁদের মধ্যে ৭২ শতাংশ নারী মানসিক চাপে ভোগেন। আবার প্রতি ছয়জনে একজন নারী প্রার্থীকে নিজ দলের কাছ থেকে অসম্মানজনক আচরণের শিকার হতে হয়। এমনকি প্রচারণার সময় নারী প্রার্থীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানো হয়।

২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আইআইডি আটটি আসনের ২ হাজার ৩৫০ জন ভোটার, দলীয় নেতা, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষণাটি করেছে।

দলীয় মনোনয়ন নিতে গিয়ে নারী হওয়ার কারণে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বলে জানান সাবেক সাংসদ মাহজাবিন খালেদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কঠিন।

মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতন হওয়ার পরেও আক্রান্ত নারী অনেক সময় আইনের আশ্রয় নিতে চান না। নিতে গেলেও হেনস্তা হতে হয়। অভিযোগপত্রে ঘটনার প্রকৃত কারণ ঘুরিয়ে লেখা হয়। ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার শিকারের আশঙ্কা থাকে। ভুক্তভোগীর আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

রাজনৈতিক সহিংসতার ধরন নারীর ক্ষেত্রে বদলে যায় বলে মন্তব্য করেন আইআইডির নীতি বিশ্লেষক অরিন হক। তিনি বলেন, শুধু নারী হওয়ার কার‌ণে ‘চরিত্র’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, গুজব ছড়ানো হয়। রাজনৈতিক দল ও সমাজের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এ জন্য দায়ী।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ঘটনা ঘটার পরে যথাযথভাবে আইনি সহায়তা দেওয়া জরুরি। তবে ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অধিক জোর দেওয়া দরকার।

সংসদে সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা থাকায় পুরুষ লাভবান হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাবের আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে নারীদের। একই সঙ্গে নারী নেতৃত্ব বাড়াতে রাজনৈতিক দলের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মাসুদা খাতুন বলেন, সহিংসতার শিকার নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পেতে সমস্যায় পড়েন।

নারী প্রতিবাদ করতে গিয়েও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হুমায়রা আজিজ। তিনি বলেন, প্রতিবাদী নারীকে সুরক্ষা দিতে সমাজ ব্যর্থ হচ্ছে। নারী আইনি কাঠামোতে কীভাবে সুরক্ষা পাবে, সে বিষয়টি এখন আলোচনা করা জরুরি।

এশিয়া ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার শাব্বির শওকত বলেন, অনেক নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও বুঝতে পারেন না। পরিবারের চাপে অনেক সিদ্ধান্ত মেনে নেন। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর প্রতি পুরুষের, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বদল করতে হবে।