এরশাদের 'নাটক' যে বার্তা দিল স্ত্রী রওশনকে

এইচ এম এরশাদ ও রওশন এরশাদ
এইচ এম এরশাদ ও রওশন এরশাদ

শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিতে (জাপা) নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ভাই জি এম কাদেরের ওপরই আস্থা রাখলেন এইচ এম এরশাদ। এ নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে অখুশি। তবে তাঁরা এরশাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন না, পরিস্থিতি দেখছেন। যদিও সিদ্ধান্তটি জানাতে মধ্যরাতের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

গত শনিবার মাঝরাতে সাংবাদিকদের বাসায় ডেকে নিয়ে জি এম কাদেরকে জাপার ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান এবং তাঁর অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ। তাঁকে সাংগঠনিক দায়িত্বও দেওয়া হয়। যদিও এর আগে একবার জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আবার সরিয়ে দিয়েছিলেন এরশাদ।

জাপার দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, এরশাদ এমন নাটক আগেও করেছেন। সর্বশেষ মধ্যরাতের ঘটনাও নাটক কি না, তা জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে। জাপার নেতারা মনে করছেন, এরশাদের এই ঘোষণা মূলত স্ত্রী রওশন এরশাদ ও তাঁর অনুসারী নেতাদের উদ্দেশে একটা বার্তা। তা হচ্ছে, জি এম কাদেরই জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নেতা। এই ঘোষণায় কার্যত দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের অবস্থান খর্ব হলো। তা ছাড়া জি এম কাদেরকে ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় সংসদেও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে।

জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, বর্তমানে এরশাদের শারীরিক অবস্থা খুবই নাজুক। তাঁর কথাবার্তা ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলের দাপ্তরিক চিঠিপত্রেও এখন ঠিকমতো সই করতে পারেন না। এ অবস্থায় তিনি ভাইকে দলের নেতৃত্বে স্থিতিশীল দেখে যেতে চান। পরে জি এম কাদেরের নেতৃত্ব নিয়ে দলে যাতে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং দলের ভেতর থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ না আসে, সেটি পরিষ্কার করতেই এরশাদ এ ঘোষণা দেন। এতে দলে রওশনপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, এরশাদকে বুঝিয়ে এ বিবৃতি নেওয়া হয়েছে।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ ফকরুল ইমাম বিষয়টিকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেন। রওশনপন্থী বলে পরিচিত এই নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সব কাজের একটা সৌন্দর্য আছে। রাজনীতিতে এমন কোনো সংকট তো নেই। পরদিন সকালেও তো এসব কথা বলা যেত।

অবশ্য জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, এরশাদ তাঁকে অন্তত তিনবার ফোন করে বাসায় ডেকে নিয়েছেন। এরপর তিনি তাঁর অভিপ্রায় জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করলে প্রতিক্রিয়ার মুখে স্ত্রী রওশনকে জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। সম্প্রতি জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ ফিরিয়ে দেওয়ার পর রওশনপন্থী নেতারা তৎপর হন। সে সময় তাঁরা যাতে এরশাদের কাছে ঘেঁষতে না পারেন, সে জন্য তাঁর বারিধারার বাসায় পাহারা বসিয়েছিলেন জি এম কাদেরের অনুসারীরা।

নতুন করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান জি এম কাদের। এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের চেয়ারম্যানের দৈনন্দিন কাজগুলোর পাশাপাশি আগামী কাউন্সিল উপলক্ষে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে এরশাদ তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি, সে জন্য সবার সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। আর এটা নিয়ে যেন কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়, পার্টির চেয়ারম্যান সে জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন।’

জাপার সূত্র জানায়, জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা করার পর জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলছিলেন। শনিবার রাতে জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার সময় দলের এক যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুর রহমান ছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ ছিলেন না। গতকাল বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনেও হাসিবুর ছাড়া জাতীয় পার্টির মহাসচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। জি এম কাদের পদ ফিরে পাওয়ার পর থেকে হাসিবুরকে জাপার বনানীর কার্যালয় এবং এরশাদের বাসায় তৎপর থাকতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে জি এম কাদের বলেন, পার্টি অফিসটা হলো একটা নিউক্লিয়াস। এটা একবারে গভর্নমেন্টের অফিস না যে এ টু জেড সবাই প্রেজেন্ট থাকবে। পার্টির সভা-সেমিনার হলে ডাকলে তাঁরা আসেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর সাংবাদিকেরা জাপায় অস্থিরতা আছে কি না, জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, ‘দলে অস্থিরতার কথা আমি একেবারে নাকচ করে দেব না। অস্থিরতা সব দলেই থাকে। তবে আমাদের দলে তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে গেছে বলে মনে করি না।’

মধ্যরাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছ থেকে প্রশ্ন ওঠার বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘এবারের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই এবং প্রশ্ন তোলার সুযোগও কম। যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন বা তুলতে চাচ্ছেন, তাঁরা প্রশ্ন তোলার জন্যই তুলছেন। তাঁদের ব্যাপারেও (পদ দেওয়ার) একই ব্যাপার হয়েছিল।’

বর্তমানে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। আর স্ত্রী রওশন এরশাদ হলেন উপনেতা। এরশাদের অবর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টির সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জি এম কাদেরকে সরিয়ে এরশাদ সম্প্রতি রওশনকে উপনেতা করেছেন। তাই এরশাদের অবর্তমানে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হতে হলে দলীয় সাংসদদের বেশির ভাগের সমর্থন পেতে হবে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা নিয়ে এখন থেকেই নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে দলের ভেতরে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থী একজন নেতা বলেন, এরশাদ যত দিন আছে, তত দিন জাতীয় পার্টি একরকম থাকবে। ওনার অবর্তমানে অনেক কিছুই ঘটবে দলে।