কাটা লাশের সঙ্গে কাটে শাকিলের কৈশোর

মো. শাকিল। ট্রেনে কাটা লাশ নিয়েই যার জীবন। ছবি: আবদুস সালাম
মো. শাকিল। ট্রেনে কাটা লাশ নিয়েই যার জীবন। ছবি: আবদুস সালাম

নিজ হাতে লাশ প্যাকেটে ভরতে ভয় পান কি না? প্রশ্ন করলে শাকিল জানায়, ‘ওপরে আল্লাহ আছে, আর নিচে আমি—কিসের ভয়!’ গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কথা হচ্ছিল মো. শাকিলের সঙ্গে। তাঁর বয়স ১৫ কি ১৬। কথা শুরুর সূত্র একটি লাশ! গতকাল রাজধানীর গেন্ডারিয়া এলাকায় ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে নিহত হন এক নারী। ট্রেনে কেটে যাওয়া নারীর শরীরের বিভিন্ন অংশভর্তি সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে রিকশাভ্যানে করে মর্গে নিয়ে আসে এই শাকিল। রিকশাভ্যান সে নিজেই চালায়। মর্গের একজনের সাহায্যে লাশকাটা ঘরে লাশটি রেখেও আসে সে। এই কাজে যে সে বেশ অভ্যস্ত, তা তার শরীরী ভাষাতেই স্পষ্ট। লাশ নামানোর পর বকশিশের অপেক্ষা করছিল শাকিল। তখনই তার সঙ্গে কথা হলো। সে জানায়, শুধু ট্রেনে কাটা পড়া লাশ নিয়েই তার কারবার। প্রায় তিন বছর ধরে এই কাজ করছে সে। ট্রেনের নিচে মানুষ কাটা পড়ার ঘটনা ঘটলেই শাকিলের ডাক পড়ে। শাকিল তার রিকশাভ্যান নিয়ে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। লাশের বিভিন্ন অংশ অবলীলায় ব্যাগে ভরে ফেলে সে। ঘটনাস্থলে থেকে লাশ প্রথমে সে নিয়ে যায় কমলাপুরের ঢাকা রেলওয়ে থানায়। সেখান থেকে শাকিল ও লাশের গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ। ঢাকার বাইরে থেকেই কাটা লাশ ঢাকায় নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা রয়েছে শাকিলের। একবার বঙ্গবন্ধু সেতুর ট্রেনে কাটা পড়া লাশ তাকে ট্রেনে করেই ঢাকায় নিয়ে আসতে হয়েছিল।

এই কাজ করে শাকিলের মাসিক আয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। পুলিশ কিছু দেয়, নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা কিছু দেন। শাকিলের মা-বাবা চট্টগ্রামে থাকেন। তাঁদের টাকা পাঠায় কি না? জানতে চাইলে সে অসংকোচে জানায়, ‘মন চাইলে পাঠাই, নাইলে নাই।’ 

ভয় কি একেবারেই পায় না সে? এই প্রশ্নের জবাবে শাকিল বলল, ভয় সে জীবনে একবার পেয়েছিল। সে নাকি একবার লাশের চড় খেয়েছিল! তা কীভাবে সম্ভব! ব্যাখ্যা করল শাকিল, টাঙ্গাইলে লাশ আনতে গিয়েছিল সে। মরদেহটি উপুড় হয়ে ছিল। যেই লাশটি ঘুরাতে যায়, অমনি মরদেহের হাতটি চড়ের মতো এসে আছড়ে পড়েছিল শাকিলের গালে। সঙ্গে সঙ্গে শাকিল জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। তারপর থেকেই সে মাঝে মাঝে স্বপ্নে লাশ দেখে।

শাকিলের থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বেশির ভাগ সময় রাত কাটিয়ে দেয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। নিজের কোনো মোবাইল ফোনও নেই। তার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায়, কমলাপুরের ঢাকা রেলওয়ে থানায় যোগাযোগ করা। শাকিল কি সারা জীবন ট্রেনে কাটা লাশই বয়ে বেড়াবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তার উত্তর, ‘আল্লাহর রহমতে আমি গাড়ি চালাতে পারি। না হলে কোনো একটা ব্যবসা করব।’ শাকিল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। আবার পড়ালেখা করার সুযোগ পেলে পড়বে কি না? জানতে চাইলে শাকিলের সরাসরি উত্তর, ‘পড়ালেখায় আর মন নেই।’