মাঠে বেগুনি ধানের দোলা

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙা গ্রামে বেগুনি রঙের ধানের ফলন। ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙা গ্রামে বেগুনি রঙের ধানের ফলন। ছবি: প্রথম আলো

চারদিকে সবুজ প্রকৃতি। মাঠের পর মাঠ বোরো ধান। সবুজ ধানগাছ দোল খাচ্ছে বাতাসে। এই সবুজ মাঠেই শোভা পাচ্ছে বেগুনি রঙের ধানগাছ। সবুজের মাঝে বেগুনি রং মাঠের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু সৌন্দর্য বাড়ায়নি, চলতি বোরো মৌসুমে গাইবান্ধার দুটি উপজেলায় বেগুনি রঙের ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকেরা বেগুনি রঙের ধান কাটায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে গাইবান্ধার দুটি উপজেলায় ৬৩ বিঘা জমিতে বেগুনি রঙের ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ৬০ বিঘা এবং সাদুল্যাপুরে তিন বিঘা।

সূত্রটি জানায়, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের দুলালী বেগম নামের এক নারী গত বছর কয়েক কেজি বেগুনি রঙের ধান কুড়িয়ে পান। ধান নিয়ে ওই নারী সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজা-ই-মাহমুদের কাছে যান। ওই কর্মকর্তার পরামর্শে গত বছর বোরো মৌসুমে চারা উৎপাদনে সেই ধান বপন করেন। প্রথমবার এক বিঘা জমিতে এই ধানের চাষ করেন। ফলনও ভালো হয়। প্রতি বিঘায় ২০ মণ ধান উৎপাদন হয়। সেই ধান নিয়ে স্থানীয়ভাবে হইচই শুরু হয়। দুলালী বেগমের সাফল্য দেখে গত বছর আমন মৌসুমে সুন্দরগঞ্জের অনেক কৃষক এই ধানের চাষ করেন।

দুলালী বেগম বলেন, তাঁকে দেখাদেখি অনেকে এই ধানের চাষ করছেন দেখে তাঁর ভালো লাগে। এলাকার কৃষকদের এই ধান চাষের জন্য উৎসাহিত করছেন তিনি।

বেগুনি ধানের গোছায় ২৫ কুশি
বেগুনি রঙের ধানের ফলন কেমন হবে, কৃষকেরা কতটা লাভবান হবেন, তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজা-ই-মাহমুদ। তিনি বলেন, বেগুনি রঙের ধানের শিষ সাধারণ উফশী ধানের মতোই। গড়ে প্রতি গোছায় ২৫টি কুশি হয়, যেখানে উফশী খেতে গড়ে ২১টি কুশি রয়েছে। কুশির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এ ধানের ফলন বেশি হয়। জীবনকাল অন্যান্য উফশী ধানের মতোই—১৪০ দিন। বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ ফলন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া বেগুনি রঙের ধানের শিষের গোড়া শক্ত। ধানগাছ ভেঙে পড়ে না সহজে। কুশি চারদিকে ছড়িয়ে থাকে। সহজে গাছ আলো–বাতাস পায় বলে পোকার আক্রমণের আশঙ্কা কম। তিনি আরও বলেন, গত এক বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই ধান চাষ অন্যান্য ধানের মতোই লাভজনক হবে।

অনুপ্রাণিত অন্য কৃষকেরাও
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙা গ্রামের কৃষক শামসুল হক এবার দুই বিঘা জমিতে বেগুনি রঙের ধানের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, দুলালী বেগমের কাছে ধানের বীজ নিয়ে এ বছর দুই বিঘা জমিতে বেগুনি রঙের ধান চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত এক বিঘা জমির ধান কেটেছেন। এক বিঘায় ফলন হয়েছে ২২ মণ। এর চালও অন্য ধানের চালের মতো সুস্বাদু বলে তিনি মন্তব্য করেন।

একই গ্রামের আরেক কৃষক শাহজাদা মিয়া জানালেন, কৌতূহল থেকে তিনি এবার বেগুনি রঙের ধান চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবার শখ করে এক বিঘা জমিতে চাষ করেছেন ফলন কেমন হয়, তা দেখার জন্য। এক বিঘায় সাড়ে ২০ মণ ধান পেয়েছেন।

একই গ্রামের আরেক কৃষক মোজাহার মিয়া জানান, গত বছর দুলালী বেগমের বেগুনি ধান দেখতে লোকের ভিড় জমেছিল। এই খবর পত্রপত্রিকায় দেখে তিনিও চাষ করার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা থেকে এবার বেগুনি রঙের ধান চাষ করেছেন।

বেগুনি রঙের ধান উৎপাদনে উৎসাহী হচ্ছেন কৃষকেরা। ছবি: প্রথম আলো
বেগুনি রঙের ধান উৎপাদনে উৎসাহী হচ্ছেন কৃষকেরা। ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরগঞ্জের সাফল্য দেখে এ বছর সাদুল্যাপুর উপজেলার কৃষকেরা বেগুনি রঙের ধান চাষ করেছেন। উপজেলার ইদিলপ্রু ইউনিয়নের চকনদী গ্রামের কৃষক শুটকু মিয়া বলেন, ‘এটা নতুন ধান। তাই পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে বেগুনি রঙের ধানের চাষ করেছি। এক বিঘায় ফলন হয়েছে ২১ মণ। আরেক বিঘা জমিতে বিআর-২৮ জাতের বোরো ধানের চাষ করেছিলাম। সেই এক বিঘায় বিআর-২৮ উৎপাদন হয়েছে ২০ মণ।’

একই ইউনিয়নের তরফ পাহাড়ি গ্রামের শাকিল মিয়া বলেন, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা থেকে এই ধানের চারা সংগ্রহ করেন তিনি। এ বছর ১৭ শতক জমিতে চাষ করেছেন। ধান উৎপাদন হয়েছে ১১ মণ। আগামী বছর তিন বিঘা জমিতে এ ধান চাষ করবেন বলে জানান তিনি।

বেগুনি রঙের ধান নিয়ে পর্যালোচনা
সাদুল্যাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খাজানুর রহমান বলেন, এই ধান দেখতে পুরোপুরি বেগুনি রঙের। ফলনও ভালো। এবার বিঘাপ্রতি ২১ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। কৃষকেরা আগ্রহ করে এই ধানের চাষ করেছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, এই ধানের চাষ সুন্দরগঞ্জে প্রথম নয়। এর আগে ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার দত্তনগর খামারে এই ধানের চাষ হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের দুলালী বেগমের বেগুনি রঙের ধান চাষে সাফল্য দেখে কৃষকেরা নিজ আগ্রহে চাষ করছেন।

বেগুনি রঙের ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে কি না, তা জানতে চাইলে উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস বলেন, এই ধানের বীজ বাজারজাত করতে প্রথমে গাজীপুরে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে (এসসিএ) পাঠাতে হবে। এসসিএ অনুমোদন দিলে তা জাতীয় বীজ বোর্ডে পাঠাতে হবে। বীজ বোর্ড অনুমোদন দিলে সেই বীজ বাজারজাত করা যাবে। তখন তাঁরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন।

এস এম ফেরদৌস আরও বলেন, বেগুনি রঙের ধান চাষে কৃষকেরা কতটা লাভবান হবেন, ফলন কী রকম হয়, সেসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে দেখা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণ শেষ হলে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে পাঠানো হবে। তবে গত এক বছর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ ধানের ফলন ভালো হয়েছে।