হরিজনপল্লিতে আনন্দ দুই কন্যা

>

এসএসসি পাস করা দুই শিক্ষার্থী প্রিয়া বাশফোর (বাঁয়ে) ও পায়েল বাশফোর
এসএসসি পাস করা দুই শিক্ষার্থী প্রিয়া বাশফোর (বাঁয়ে) ও পায়েল বাশফোর

প্রিয়া হতে চায় পুলিশ কর্মকর্তা, আর পায়েল শিক্ষক। কিন্তু পড়াশোনার খরচ নিয়ে চিন্তায় তাদের পরিবার।

তারা দুজনই নিতান্ত গরিব ঘরের সন্তান। ঠিকমতো খাবার জোটে না। কিন্তু শতকষ্টের মধ্যেও তারা দমেনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে ছিনিয়ে এনেছে একের পর এক সাফল্য। এমনকি ঠেকিয়েছে নিজেদের বাল্যবিবাহও। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তারা এসএসসি পরীক্ষাতেও কৃতকার্য হয়েছে। এ যেন দুঃখের ঘরে সুখের আলো।

এই গর্বিত সন্তান হলো প্রিয়া বাশফোর ও পায়েল বাশফোর। তারা পরস্পরের মামাতো-ফুপাতো বোন। তাদের ঘর পাশাপাশি। দুজন পড়াশোনাও করে একই স্কুলে। এক সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে। তাদের বসবাস নেত্রকোনা শহরের চকপাড়া এলাকায় হরিজনপল্লিতে। প্রিয়া পড়াশোনা করে পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে হরিজনদের দুঃখ ঘোচাতে চায়। আর পায়েল চায় শিক্ষক হয়ে তাদের সম্প্রদায়ে আলো বিলাতে।

স্থানীয় বাসিন্দা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং দুই শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রিয়া ও পায়েল শহরের বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে যথাক্রমে জিপিএ–৩.৭৯ ও পায়েল জিপিএ-৪.৫০ পায়। এরপর ভর্তি হয় শহরের সাতপাই এলাকায় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে। ২০১৫ সালে মেয়ে দুটিকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায় তাদের পরিবার। তখন তারা সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষক তমা রায়কে সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেয় তারা। জেএসসিতে প্রিয়া পায় জিপিএ-৩.৭৯ আর পায়েল জিপিএ-৪। এবার এসএসসিতে বাণিজ্য শাখা থেকে প্রিয়া ও পায়েল উভয়েই জিপিএ-৩.৬১ অর্জন করেছে।

প্রিয়ার বাবা সুভাস বাশফোর একজন ঝাড়ুদার। সারা দিন খেটে যা পান, তা দিয়েই চালাতে হয় সংসার আর তিন মেয়ে ও এক ছেলের পড়াশোনার খরচ। মা মিনতি বাশফোর গৃহিণী। সন্তানদের মধ্যে প্রিয়া সবার বড়। মেজ বোন চাঁদনি বাশফোর দশম শ্রেণিতে আর সোনালি বাশফোর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র ভাই সুবীর বাশফোর পড়ে প্রথম শ্রেণিতে।

পায়েলের মা–বাবাও ঝাড়ুদার। তাদের সংসারেও দুঃখ নিত্যদিনের সঙ্গী। বাবা ইমরিত বাশফোর, মা মালতি বাশফোর দিনরাত খেটে যা পান, তা দিয়েই চলতে হয়। দুই ভাইবোনের মধ্যে পায়েল বড়। ভাই আশিক বাশফোর শহরের সাতপাই এলাকায় নেত্রকোনা উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

গত সোমবার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে তমা রায় মুঠোফোনে তাদের সাফল্যের খবর দেয়। এদিন তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের লোকজন ও সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। কলোনিতে বসবাসকারী ৩৫টি ঘরের তিন শতাধিক বাসিন্দার মধ্যে প্রিয়া ও পায়েলই হলো প্রথম এসএসসি পাস করা মেয়ে। প্রিয়া বাশফোর বলে, ‘আমি লেখাপড়া করে পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে হরিজনদের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’ আর পায়েল বাশফোর বলে, ‘আমি তমা ম্যাডামের মতো একজন ভালো শিক্ষক হয়ে আমাদের সম্প্রদায়ে মধ্যে আলো বিলাতে চাই।’

দুজনের মা-বাবার সঙ্গে কথা হলে জানান, তাঁদের একচিলতে থাকার ঘরটি ছাড়া আর কিছুই নেই। ছোটবেলা থেকেই মেয়ে দুটি খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। কখনো কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। এখন পাস করলেও কলেজে ভর্তি হতে এবং পড়াশোনা চালাতে যে টাকার প্রয়োজন, সেই সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তা তাড়া করছে তাদের।

শিক্ষক তমা রায় বলেন, ‘আজ আমার শুধুই আনন্দ আর আনন্দ। ওই মেয়ে দুটি আমাদের স্কুলের গর্ব। ওরা নিজেদের জয় করতে শিখছে। ওরা নৃত্য ও নাটকেও ভালো পারদর্শী।’