সমস্যা মধ্যেও সাফল্যে উজ্জ্বল এক বিদ্যালয়ের গল্প

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছে। সম্প্রতি ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  প্রথম আলো
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছে। সম্প্রতি ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রথম আলো

সমস্যা একেবারে কম না। প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। শ্রেণিকক্ষ–সংকট। খেলার মাঠে খেলা যায় না। বর্ষা এলে হাওরের পানিতে তলিয়ে যায় মাঠ ও ভবন। কিন্তু এত সংকট মোকাবিলা করেই নিজেদের টানা সাফল্য ধরে রেখেছে ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওরপারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি।

এ সাফল্যের পেছনে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের নানা উদ্ভাবনী কাজের ছক এবং তা বাস্তবায়নে সহকর্মীদের দলবদ্ধ পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু চাকরির প্রচলিত নিয়মে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের আটকে রাখেননি। বরং সৃজনশীলতা দিয়ে পরিচিত করে তুলেছেনে বিদ্যালয়টিকে।

গত মঙ্গলবার সকালে রাজনগর-বালাগঞ্জ খেয়াঘাট সড়কের মোকামবাজার থেকেই ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চোখে পড়ে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথটি কাঁচা। পথের দুধারে কাঁচা–পাকা ধান।

সম্প্রতি বিদ্যালয়ে ঢুকে দেখা গেল, একটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিচ্ছেন একজন শিক্ষিকা। শিক্ষক মিলনায়তনে প্রধান শিক্ষক রজব আলীসহ তিনজন শিক্ষক পরীক্ষার খাতাপত্র দেখছেন।

বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৪৭। শিক্ষকের পদ আছে সাতটি। কর্মরত আছেন প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচজন। বিদ্যালয়টিতে এলাকার ভেড়িগাঁও, ছুয়াববালি, বাঘমারা, মোকামবাজার, সাদাপুর ও মুনিয়ারপাড় গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে। এ বিদ্যালয়ের অবস্থান কাউয়াদীঘি হাওরের একটি অংশে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, বিদ্যালয়টি এ পর্যন্ত রাজনগর উপজেলা পর্যায়ে পাঁচবার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের সম্মান পেয়েছে। সালগুলো হচ্ছে ২০০৬ থেকে ২০০৯ এবং ২০১৮। আর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রজব আলী ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সেই থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সাফল্য শতভাগ। এ পর্যন্ত সমাপনী পরীক্ষায় ১৫০ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২০১৮ সালে সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ছিল ৫০ জন। সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। ৩০ জন পেয়েছে জিপিএ-৫। ২০০৩ সাল থেকে বিদ্যালয়টিতে নিয়মিত বৃত্তি আসছে। ২০১৫ সালে বৃত্তি এসেছিল ২২টি। এর মধ্যে ১৯টি ট্যালেন্টপুলে। সে বছর সিলেট বিভাগে সেরা হয়েছিল এই ভেড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত বছর (২০১৮) বৃত্তি এসেছে সাতটি। এর মধ্যে পাঁচটি ট্যালেন্টপুলে। এ তো গেল লেখাপড়ার ফলাফলের দিক। বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে উপজেলা পর্যায়ে একাধিকবার বিদ্যালয়টি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

ভেড়িগাঁও গ্রামের গিয়াস খান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুলটা উপজেলার মধ্যে ভালো। প্রধান শিক্ষক স্কুলের জন্য খুব খাটেন। সব স্যার খুব দায়িত্বশীল। তাঁরা শুধু স্কুলেই পড়ান না। বাড়িঘরে গিয়েও খোঁজ নেন।’

তবে এই সাফল্যের পথটা অত মসৃণ নয়। হাওরপারের এই বিদ্যালয়ে সমস্যার কমতি নেই। িদ্যালয়ে দুটো ভবন আছে। একটি আধা পাকা। পাকা দেয়াল, টিনের চাল। গত ১৫ এপ্রিল কালবৈশাখীতে টিনের চালের একাংশ উড়ে গেছে। বিদ্যালয়ের অনেক রকম কাগজপত্র বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়েছে। টিনশেডের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। অপর ভবনটি দোতলা। ভবনের ছাদের উত্তর পাশের ‘গাইড ওয়াল’ ধসে পড়েছে। ভবনের প্লাস্টার খসে পড়ছে। দরজা-জানালা ভেঙে যাচ্ছে। ভবনগুলোতে শ্রেণিকক্ষ ছোট। ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসতে হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হচ্ছে। অপর্যাপ্ত বেঞ্চ ও ডেস্ক। প্রায় এক বছর ধরে শৌচাগারের মটর নষ্ট। বিদ্যালয়ের মাঠটি নিচু। বর্ষাকালে প্রায় বছরই বিদ্যালয়টি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়ে পাশের একটি বাড়িতে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়।

প্রধান শিক্ষক রজব আলী জানান, শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খোঁজখবর রাখেন শিক্ষকেরা।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাফর আল সাদেক বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের নিজস্ব প্ল্যানে স্কুলটি চলছে। বছরের শুরু থেকেই সমাপনী পরীক্ষার্থীদের জন্য ছক করেন। বাড়তি নজরদারি করেন। এতে শুধু বৃত্তি বা জিপিএই পাচ্ছে না; সবাই পাস করছে।’ শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, বিদ্যালয়টির নতুন একটি ভবন ডিজাইনের কাজ চলছে। হাওরাঞ্চল হওয়ায় ভবনটি একটু আলাদা ধরনের হবে। এতে সময় লাগছে।