ওসি বরখাস্ত হলেও অন্যরা বহাল

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি
সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি ও অসদাচরণের প্রমাণ পেয়েছিল পুলিশেরই তদন্ত কমিটি। সেই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ৯ দিন পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ফেনীর পুলিশ সুপার ও সোনাগাজী থানার দুই উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে কমিটি ব্যবস্থা নিতে বললেও তাঁরা এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছেন।

মামলার বাদীর অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তর ঢিলেমি করছে। পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাদী। তিনি এই চার পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন এসআইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে জেলা পুলিশ। আর পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।

ওসি ছাড়া কেন অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছে সে অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পুলিশের। কারণ, প্রতিবেদনটি এখনো পুলিশ সদর দপ্তরের কাছেই আছে। এখন পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। তাই আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না ওসি ছাড়া কেন অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

গত ৬ এপ্রিল নুসরাত জাহানকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেন মাদ্রাসার একদল ছাত্রছাত্রী। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন। এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া এবং মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এমনকি জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম অভিযুক্ত ওসিকে রক্ষায় ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য পাঠান পুলিশ সদর দপ্তরে।

বিষয়গুলো নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তর সমালোচনা হয়। এর মধ্যে নুসরাতের পরিবারের দাবির মুখে প্রথমে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে বদলি করা হয়। পরে এ ঘটনায় পুলিশের দায়দায়িত্ব খতিয়ে দেখতে ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম রুহুল আমিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ এপ্রিল কমিটি তাদের প্রতিবেদন পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে জমা দেয়।

প্রতিবেদনে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম ও এসআই ইকবালকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও এসআই আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও তাঁদের নন অপারেশনাল ইউনিটে বদলির সুপারিশ করা হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, অভিযুক্ত দুই এসআইয়ের একজন ইকবালকে ঘটনার পর ফুলগাজী থানায় বদলি করা হয়। ওই থানার ওসির দায়িত্বে থাকা কুতুবুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইকবাল এখনো দায়িত্বে আছেন। অন্য এসআই আবু ইউসুফ এখনো সোনাগাজী থানায় দায়িত্বরত। পুলিশ সুপারও নিজ জেলায় বহাল আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও এসআই ইকবাল হোসেন নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন। পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার সকাল ১০টায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলে যাননি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেন। পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নির্দেশে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি কে এনামুল কবীরও তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ সোনাগাজী থানার ওসির বিরুদ্ধে। তা হলো, অদক্ষতা, পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, দায়িত্বে অবহেলা ও অসদাচরণ। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে শ্নীলতহানি করেছেন, এটা জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি ওসি। ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ করেন নুসরাত। এরপর সোনাগাজী থানায় যাওয়ার পর নিয়ম ভেঙে তাঁর বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। ভিডিও করার সময় নুসরাত দুই হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদছিলেন। এ সময় ওসি বলতে থাকেন, মুখ থেকে হাত সরাও। কান্না থামাও। এমন কিছু হয়নি যে এখনো তোমাকে কাঁদতে হবে।

এদিকে নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প দিনের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংস্থাটি এ পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ৮ আসামি ছাড়াও ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের ১৮ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

নুসরাতের ভাই ও মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেম ছাড়া অভিযুক্ত সবাই এখনো নিজ নিজ কর্মস্থলে বহাল আছেন। তাহলে কী করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো সেটা বুঝতে পারছি না। এই পুলিশ কর্মকর্তারা মামলার আসামিদের সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। তাঁদেরও আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হোক।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আমাদের দাবি ছিল এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক। সরাসরি হত্যায় যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরাসহ এর পরিকল্পনাকারী, তাঁদের সহায়তাকারী এবং যাঁরা এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, প্রত্যেকেই যেন আসামির তালিকাভুক্ত হন।’