জুরাইনে বছরভর নোংরা পানি

জুরাইন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে পানির সমস্যা। আশপাশের মসজিদের পাম্প থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করছেন এলাকাবাসী।  ছবি: হাসান রাজা
জুরাইন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে পানির সমস্যা। আশপাশের মসজিদের পাম্প থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করছেন এলাকাবাসী। ছবি: হাসান রাজা

জুরাইনে কয়েক বছর ধরে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অধিকাংশ বাসাবাড়িতে ওয়াসার পুরোনো সরবরাহ লাইন দিয়ে আসা পানি নোংরা ও দুর্গন্ধময়। এই পানি পান করা বা রান্নায় ব্যবহার অনুপযোগী।

বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে জারের পানি কিনে বা মসজিদের গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে দৈনন্দিন কাজ করেন। বারবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ লাইন প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো। কোথাও কোথাও সেগুলো মাটির প্রায় ১২ ফুট নিচে চলে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পাইপ ভেঙে লাইনে বর্জ্য ঢুকছে। ফলে পানিতে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আকবর হোসেন বলেন, এলাকায় ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। লাইনে যে পানি আসে, তা দিয়ে গোসল ছাড়া ঘরের অন্যান্য কাজ করা যায় না। অনেক সময় গোসল করার পর শরীর থেকেও একধরনের দুর্গন্ধ আসে। নোংরা পানি আসে সারা বছরই। গরমে পরিস্থিতি আরও খারাপ। সরবরাহও কমে যায়।

পানিসংকট নিরসনে জুরাইনের প্রায় ২০টি মসজিদের পাশে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে বাসিন্দাদের উদ্যোগে। সেখান থেকে সারি বেঁধে দিনের বিভিন্ন সময় খাবার ও রান্নার পানি সংগ্রহ করেন বাসিন্দারা। এ ছাড়া অনেকে পান ও রান্নার জন্য জারের পানি কিনছেন। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে প্রায় চার বছর আগে ওয়াসাকে চিঠি দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার প্রতিকার মেলেনি।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, জুরাইনে নতুন করে ওয়াসার পাইপ বসানো হবে। তবে ডিএসসিসি বলছে, ইতিমধ্যে জুরাইনের প্রধান সড়কগুলো সংস্কারে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজ করছে ডিএসসিসি। সংস্কারকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থায় ওয়াসার পক্ষ থেকে নতুন করে পাইপ বসানোর সুযোগ নেই। অথচ এই সংস্কারকাজ শুরুর আগে ওয়াসাকে নতুন পানির লাইন বসাতে বলেছিলেন ডিএসসিসির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নূর হোসেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ বলে দাবি করেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। এরপর জুরাইনের এক বাসিন্দা তাঁকে ওয়াসার পানি দিয়ে বানানো শরবত খাওয়াতে গেলে তিনি তা খেতে অস্বীকৃতি জানান। ওয়াসার দাবি, ওই এলাকার পানিও বিশুদ্ধ।

জুরাইনে গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। পানিসংকটের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়েছে নোংরা পানি। এর মধ্যে ১২৮/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে পানির ট্যাংকে দেখা যায়, ওয়াসার সরবরাহ করা পানি কালচে। এই সড়কের ৮৪/২, ১৯৮/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে একই চিত্র দেখা গেছে। এসব বাড়িতে শুধু গোসলের কাজে ওয়াসার পানি ব্যবহার করছেন বাসিন্দারা। রান্নাবান্না বা খাবারের জন্য পাশের দারুস সালাম জামে মসজিদের গভীর নলকূপের লাইনের পানি ব্যবহার করছেন তাঁরা।

মিষ্টির দোকান এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার বলেন, এই পানি দিয়ে ভাত বা তরকারি রান্না করলে ফেনা ওঠে। খাবারের রং বা স্বাদও পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মসজিদের লাইন থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়।

জুরাইনের ঋষিপাড়ায় পানিসংকটের চিত্র আরও ভয়াবহ। এ এলাকার বাসাবাড়ির নিচে পানি সংরক্ষণের ট্যাংকে ওয়াসার লাইন থেকে সরাসরি পানি যায় না। ফলে অধিকাংশ বাড়িতে টানা মোটর লাগানো দেখা গেছে। রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসব বাড়িতে পানি টেনে নেন বাসিন্দারা।

ঋষিপাড়ার ৬৬৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাসিন্দা নাদিমুল ইসলাম বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে এই এলাকায় পানির সংকট শুরু হয়। এতে প্রতিটি পরিবারকে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

ডিএসসিসির সচিব দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নগর ভবনে ডিএসসিসির দ্বাদশ করপোরেশন সভায় উপস্থিত ছিলেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। এ সভায় হাজী খোরশেদ আলী সরদার রোডসহ জুরাইনের বিভিন্ন এলাকার পানিসংকটের চিত্র তুলে ধরেন ডিএসসিসির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নূর হোসেন। তিনি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন। তখন ওয়াসার এমডি এ সমস্যা সমাধানে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওয়াসা কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

মোহাম্মদ নূর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই বোর্ড সভার তিন বছর আগে একাধিকবার ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চার থেকে পাঁচটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব চিঠিতে ডিএসসিসি মেয়রও সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অথচ দূষিত পানি ব্যবহার করে মহল্লার অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখন জীবন বাঁচাতে পানির জন্য মসজিদে মসজিদে ছুটছেন বাসিন্দারা। অথচ জনপ্রতিনিধি হয়ে তাঁকে জনগণের কাছে জবাব দিতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে ওয়াসার মোডস জোন-৭-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবিদ হোসেন বলেন, জুরাইন এলাকার পুরোনো পাইপগুলো সরিয়ে নতুন লাইন নির্মাণে ওয়াসার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কবে তা বাস্তবায়ন হবে, তা তিনি জানেন না। এ ছাড়া এসব পাইপ বসাতে নতুন রাস্তাগুলোয় খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।