হাওরের ধানে খুশি কৃষক, দাম নিয়ে চরম হতাশা

হাওরে সাত একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন কৃষক মফিজ উদ্দিন। আবাদ, ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। বিনিময়ে ধান পেয়েছেন ১৫০ মণ। এই ফলনে খুশি হলেও ধানের বর্তমান দাম নিয়ে চরম হতাশ মফিজ উদ্দিন।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপারের ঘাগটিয়া গ্রামে মফিজ উদ্দিন একা নন, ধানের দাম নিয়ে এই হতাশা এখন হাওরজুড়ে। কৃষকেরা বলছেন, এক বিঘা জমি আবাদে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়, সেই জমিতে পাওয়া ধান বিক্রি করে তার খরচই উঠছে না।

সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটা এখন শেষ পর্যায়ে। জেলায় এবার ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। কৃষকদের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানালেও তা হয়নি। বরং বছর বছর কমেছে। এবার মাত্র ৬ হাজার ৫০৮ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের বরাদ্দ এসেছে। অথচ ২০১৬ সালে ১৫ হাজার, ২০১৮ সালে ৬ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক ধান কেনা হয়। এবার খাদ্য বিভাগ থেকে ধানের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আর কৃষকদের দাবি ছিল ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রয়ের।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১ হাজার ৪০ টাকা। এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে, মাঠের চিত্র ভিন্ন। হাওর এলাকায় এখন ভেজা ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। শুকনো ধান ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। মাস দু-এক পর ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তাই যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা ‘পানির দরে’ ধান বিক্রি করছেন না। আবার বোরো আবাদের সময় ঋণ নেওয়ায় এবং পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে কৃষককে বাধ্য হয়েই কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।

কৃষক মফিজ উদ্দিন বলছিলেন, তাঁর পরিবারে আটজন লোক। এর মধ্যে দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। তাদের লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ নির্ভর করে এই ধানের ওপর। হাওরে সব কৃষক পরিবারের একই অবস্থা। তারা কষ্টে ধান ফলায় কিন্তু দাম পায় না, তাই কৃষকদের কষ্ট আর ঘোচে না।

একই গ্রামের আরেক কৃষক আবু হানিফ বলেন, ‘কৃষকের দুঃখ কেউ বোঝে না। মুখে অনেকেই অনেক কথা বলে। ধান পাইছি এতে খুশি, কিন্তু ধানের যে দাম তাতে তো অর্ধেক বছর বউ-বাচ্চাদের নিয়া চলা যাইত না।’

হাওরপারের কয়েকজন কৃষক জানান, ২০১৭ সালে হাওরে ফসলহানির প্রভাব এখনো কৃষক পরিবারে রয়ে গেছে। বোরো আবাদের সময় কমবেশি সব কৃষককে ঋণ করতে হয়। ধান বিক্রি করে সেই ঋণ পরিশোধ করেন তাঁরা। কিন্তু ওই বছর কোনো ধান না পাওয়ায় কৃষকেরা ঋণের জাল থেকে মুক্ত হতে পারেননি। হাওরে একবার ফসলহানি হলে এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের কয়েক বছর লেগে যায়।

ধানের দর প্রতি মণ ১ হাজার ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে জেলা কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, গুদামে ধান দেওয়ায় কৃষকদের কোনো লাভ হয় না। কৃষকের নামে ধান দেয় অন্যরা। তাই কৃষকদের স্বার্থে সরাসরি মাঠ থেকে ধান কিনতে হবে।

সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ধান বেচাকেনা হয় ধরমপাশার মধ্যনগর এলাকায়। মধ্যনগর ধান-চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম ফারুকী জানান, এখন ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ। অথচ আগে এই সময় ধানের মণ ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।

সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সংসদে এবং খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করি, সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধানের পরিমাণ বাড়াবে এবং কৃষকেরা যেন সরাসরি তাঁদের ধান গুদামে দিতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে।’

জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক মো. জাকারিয়া মুস্তফা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ধান কেনার জন্য উপজেলা কমিটির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন চলছে। কোনো কোনো উপজেলায় কৃষক নির্বাচন শেষ। চলতি সপ্তাহ থেকেই ধান কেনা শুরু হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা।’