শূন্য ঘরে হাহাকার জাগে মা মেহেরুন্নেসার

ব্যস্ত থাকতে প্রায়ই নকশি কাঁথা সেলাই করতে বসেন মেহেরুন্নেসা। ছবি: শহীদুল ইসলাম
ব্যস্ত থাকতে প্রায়ই নকশি কাঁথা সেলাই করতে বসেন মেহেরুন্নেসা। ছবি: শহীদুল ইসলাম

প্রায় ২৬ বছর আগে বড় ছেলে পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেন। তারপর থেকে ছেলের শোয়ার ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকে। ভালো-মন্দ খবর পেলে ছেলে আসা–যাওয়া করেন। বাকি সময়টা শূন্যই থাকে ঘরটি। ছোট ছেলে শহরে পেশা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়ে বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ি। খালি বাড়ি দেখে মন কেমন করে ওঠে মা মেহেরুন্নেসার (৬০)।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রসাদপাড়া গ্রামে থাকেন মেহেরুন্নেসা। স্বামী আনসার আলী অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। বেশির ভাগ সময়ই তিনি সুস্থ থাকেন না। তাই ঘরে-বাইরের কাজ একাই সামলাতে হয় মেহেরুন্নেসাকে। তারপরও তাঁর সময় কাটে না। অফুরন্ত অবসর কখনো কখনো উদাস করে দেয়। ছেলেমেয়েকে কাছে পেতে মনটা ছটফট করে ওঠে। বড় ছেলের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ওর ঘরটায় ঘুমানোর কেউ নেই। আগে যেমন ঘুম থেকে উঠেই ছেলেকে ঘরে পেতাম, সে আর কখনো হবার নয়। ও থাকে রাজশাহী শহরে।’

মেহেরুন্নেসার বাড়ি আর ছেলেমেয়েদের পদচারণে গমগম করে ওঠে না। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে একলা মা নকশি কাঁথা নিয়ে বসেন। একমনে সেলাই করেন।

এদিকে হাতের কাছে ছেলেরা না থাকায় আরেক সংকট তৈরি হয়েছে। সংসার-ঘর-গেরস্থালি সব তাঁকেই সামলাতে হয়। স্বামী খুব একটা সুস্থ থাকেন না, এটা নিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা হয়। এর ওপর আবার পারিবারিক ফলনের বিষয়টিও তাঁকে দেখতে হচ্ছে। এবার ধানের দাম কম। ধান কাটার শ্রমিক মিলছে না। মা-ই ছুটে যাচ্ছেন শ্রমিকদের বাড়িতে। কাউকে না পেয়ে একাই ফিরে আসছেন ধানখেতে। একধরনের হাহাকার তাঁকে তাড়া করে। মা শূন্য দৃষ্টিতে দেখেন পাকা ধানের মাঠ। তাকিয়ে থাকেন শহরের রাস্তার দিকে।

মেহেরুন্নেসা জানালেন, বড় ছেলে ফারুক হোসেন ২৬ বছর ধরে রাজশাহী শহরে থাকেন। শহরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে শহরেই থাকেন। ছোট ছেলে আবদুল্লাহ গোপালগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের বিয়ে হয়ে গেছে।

মাঠের ফলন তদারকিও করেন মেহেরুন্নেসা। ছবি: শহীদুল ইসলাম
মাঠের ফলন তদারকিও করেন মেহেরুন্নেসা। ছবি: শহীদুল ইসলাম

আজ রোববার ভোরে এই মায়ের প্রাত্যহিক জীবনের শুরুটা দেখার জন্য প্রসাদপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, দোতলা মাটির বাড়িটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। নিরিবিলি বাড়িতে জোড়া ঘুঘু এসে বাসা বেঁধেছে। উঠোনের ডালিমগাছটায় একটা টুনটুনি পাখির বাসা। এরাই এখন তাঁর সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। সময় কাটাতে মা বাড়ির বারান্দায় নকশি কাঁথা সেলাই করছেন। বললেন, সময় কাটে না। বসে বসে সেলাই করেন। দেখাতে নিয়ে গেলেন পুকুরপাড়। সবখানেই যেন একধরনের নির্জনতা। কোথাও কেউ নেই। বাড়ির পাশে ধানখেত। সেটিও দেখাতে নিয়ে গেলেন।

ধানের খেতে পানি জমেছে। সব ধান পড়ে রয়েছে। মা বললেন, দুই ছেলে বাইরে। ওদের বাবাও অসুস্থ। তাঁকেই সব দেখতে হয়। এই ধান লাগানো থেকে মাড়াই পর্যন্ত তাঁকে দেখভাল করতে হয়। এবার ধানের দাম কম। ধান কাটার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের ছেলেসন্তান রয়েছে, তাঁরা ছেলেদের সঙ্গে করে কাটছেন। অনেকে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাটছেন। কিন্তু তিনি কাউকে পাচ্ছেন না। বললেন, ‘স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক ছেলের নাম রাম। তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। বাড়িতে নিয়মিত ওঠাবসা করে। সংসারের সব ফুটফরমাশ খাটে। ও আমাকে খুব ভালোবাসে। একবার অভিমান করে ভারতে চলে গেল। সেখানে থেকে শুধু আমার সঙ্গেই ফোনে যোগাযোগ রেখেছিল। রামই যেন আমার হাত-পা। এবার সেই রামও নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার পাশে কেউ নেই।’

মা মেহেরুন্নেসা বললেন, ১০ দিন আগে ধান কাটার লোক ঠিক করেছেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত আসেননি। আগে শ্রমিকেরা ধানের বিনিময়ে ধান কেটে দিতেন। এখন একদল শ্রমিক ধান কেটে দিয়ে যান। আরেক দল বাড়িতে নিয়ে যান। সব আলাদা করতে হচ্ছে। ধান কাটা একজন শ্রমিকের দাম ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা।

মাঝেমধ্যেই ছেলেমেয়ের জন্য মন কেমন করে মা মেহেরুন্নেসার। ছবি: শহীদুল ইসলাম
মাঝেমধ্যেই ছেলেমেয়ের জন্য মন কেমন করে মা মেহেরুন্নেসার। ছবি: শহীদুল ইসলাম

এত টাকা ব্যয় করে ধান কেটেইবা কী করবেন, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা তাঁর। একা বাড়িতে সব ভাবনা এসে জড়ো হয় মাথায়। ছেলেমেয়েদের নিয়েও দুশ্চিন্তা করেন। কারও যেন অমঙ্গল কিছু না হয়, তা নিয়ে প্রার্থনা করেন।

এই মায়ের বড় ছেলে ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা হয় রাজশাহীতে এসে। বললেন, তাঁর শারীরিক কিছু সমস্যা হয়েছে। এ নিয়ে মায়ের দুর্ভাবনার শেষ নেই। চিকিৎসার জন্য ভারতে গেলে ভালো হয়—এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মা পাসপোর্ট করার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,‘ আমার সময় হয় না। মা খবর নিতেই থাকেন। শেষ পর্যন্ত ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ আমি ভারতে যাচ্ছি না। এ নিয়েও মায়ের উদ্বেগ। মা ভেবেছেন, আমি হয়তো বিদেশ যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারছি না। মা সেই টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

ফারুক হোসেন বললেন, ‘মাকে কত কিছু ভাবতে হচ্ছে, এটা ভাবলেও অবাক হতে হয়।’