'মুহূর্তে বিমানটি ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়'

রানওয়ে স্পর্শ করে ছিটকে পড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি।
রানওয়ে স্পর্শ করে ছিটকে পড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি।

‘বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে অনেকখানি দূরে গিয়ে পড়ে। মুহূর্তে তা ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়।’ ৮ মে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এ কথা বলেন আহত যাত্রী রেজওয়ানা খান। গত শুক্রবার রাতে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরে আসা ১০ আরোহীর মধ্যে তিনিও একজন।

মিয়ানমারের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটে ৩৫ আরোহী নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি।

রেজওয়ানা জানান, বিমানটি ছিটকে পড়ার পর দরজা খোলা যাচ্ছিল না। ১০ মিনিট পর বাইরে থেকে দরজা খুলে যাত্রী ও ক্রুদের উদ্ধার করা হয়।

স্টার কম্পিউটার সিস্টেমস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেজওয়ানা খান। গতকাল শনিবার তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। দুর্ঘটনার শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, সেদিন ইয়াঙ্গুনের আকাশে কালো মেঘ ছিল। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ঠিক তখনই বিমানের ককপিট থেকে পাইলটের ঘোষণা আসে, ‘আবহাওয়া ভালো না। তাই আমরা একটু দূরে চলে যাচ্ছি।’ ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দর থেকে দূরে চলে যাওয়া পর পরিষ্কার আকাশে উড়ছিল বিমানটি। আধা ঘণ্টা পর আবারও বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা করেন পাইলট শামীম নজরুল। বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে আসে। প্রচণ্ড গতিতে আসা সেই বাতাসে ছিটকে রানওয়ে থেকে দূরে পড়ে বিমানটি। মুহূর্তের মধ্যে এটি ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। তিনি বলেন, হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট লোকজন ও ব্লগের লেখা থেকে তিনি জেনেছেন, বিমানটি রানওয়ে থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট দূরে ছিটকে পড়েছিল।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পরপরই আহত অন্য যাত্রীদের সঙ্গে রেজওয়ানাকে প্রথমে মিয়ানমারের জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরে রেজওয়ানাকে এয়ার ওয়ে ইউ নামে অন্য একটি আন্তর্জাতিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১০ মে রাতে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে তাঁকে দেশে আনা হয়।

রেজওয়ানা খান বলেন, প্রতিষ্ঠানের কাজে ছয় মাস পরপর তাঁকে মিয়ানমার যেতে হয়। প্রতিবারই থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হয়ে ইয়াঙ্গুন যান তিনি। কিন্তু জরুরি ব্যবসায়িক কাজে গত বুধবার বিমানের সরাসরি ফ্লাইটে টিকিট কেনেন। তবে বেলা পৌনে ১১টার ফ্লাইটটি ঢাকা ছাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর বিকেল চারটার দিকে। বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমা ছেড়ে মিয়ানমারে ঢোকার পরও আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরের কাছাকাছি এটি চলে আসার সময় আকাশ কালো মেঘে ঢাকা ছিল। বিমানের পেছনের আসনে বসে সেই দৃশ্যই দেখছিলেন তিনি।

রেজওয়ানা খান বলেন, বিমানটি অবতরণের সময় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। আধা ঘণ্টার জন্য বিমানটি দূরে চলে যায়। বিমানটি ফিরে আসার সময়ও আবহাওয়া বদলে যায়নি। তখন বৃষ্টিও হচ্ছিল। ইয়াঙ্গুনে তখন ইফতারের সময় হয়ে এসেছিল। তিনি বলেন, ‘পাইলট হয়তো অবতরণের অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু অবতরণের সময় মনে হলো এটি হঠাৎ যেন ছিটকে গেল। তখন ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। দূরে ছিটকে পড়ার সঙ্গে আমার মাথার ওপর প্লাস্টিকের বক্স ভেঙে পড়ল। দেখতে পেলাম পুরো বিমানটি লম্বালম্বি তিন টুকরো হয়ে গেল। বিমানের মাঝখানে এক টুকরো, আর পেছনে ও সামনের অংশে আরও দুই টুকরো।’

প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ায় রেজওয়ানার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড ধাক্কায় যাত্রী কয়েকজন নিজেদের সিট থেকে পড়ে গেলেন। কেবিন ক্রু ফারজানা দুই সিটের মাঝে পড়েছিলেন। বিমানের দুটি দরজা দেবে যায়। ফারজানা ব্যথা পাওয়ায় উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তখন ফারজানা চিৎকার করে বলছিলেন, “আপনার আগে দরজা খোলেন।” আরেক বাবাকে দেখলাম তাঁর ছোট্ট শিশুকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। ওই বাবা কিছুটা ব্যথা পেয়েছিলেন, কিন্তু শিশুটির কোনো ক্ষতি হয়নি।’

রেজওয়ানা খান বলেন, ‘আমরা ভেতর থেকে দরজা খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বিমান থেকে বের হাওয়ার দুটি দরজার একটিও খোলা যাচ্ছিল না। ১০ মিনিট পর বাইরে থেকে দরজা খুলে আমাদের উদ্ধার করা হয়। বিমান থেকে সব যাত্রীকে নামিয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময়ও বৃষ্টি হচ্ছিল। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাঁর রহমতে আমি দ্বিতীয়বার জীবন পেলাম।’

বিমানটিতে আগুন না ধরা অলৌকিক ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অবসরপ্রাপ্ত বৈমানিক মো. নাসিমুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ড্যাশ–৮–এর কিউ ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি লম্বায় ১০৮ ফুট। যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৭৪। দুর্ঘটনার দিন যাত্রী ছিলেন অর্ধেকেরও কম। এতে বিমানটি হালকা ছিল। তিনি বলেন, এ ধরনের বিমানগুলো অবতরণের সময় প্রায় দেড় শ কিলোমিটার গতিতে থাকে। তবে সেটা রানওয়ে থেকে দুই হাজার ফুট দূরে পড়েছিল কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। এমনও হতে পারে, এটা অবতরণের পর ছেঁচড়ে গিয়ে রানওয়ের পাশে পড়ায় টুকরো হয়ে গেছে। তাঁর মতে, অলৌকিকভাবে এটায় আগুন ধরেনি।

এদিকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক জানান, বিমান দুর্ঘটনার ঘটনায় মূল তদন্তের কাজ করছে মিয়ানমারের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। আর ঘটনাটি তদন্তে বিমানের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হচ্ছেন বিমানের চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী। এই কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।