ব্রিটিশ গুজব এবং রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিঠি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস

‘গুজব ছড়াবেন না’, ‘গুজবে কান দেবেন না’ এমন হরেক কথা শোনা যায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময়। মজার ব্যাপার হলো, এই ‘গুজব’ বা কোনো কিছু নিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারের ব্যাপারটা ফেসবুক, টুইটার আর গুগলের জামানার নয়। এর জন্ম অনেক অনেক কাল আগে। লিখিত ইতিহাসে ৫১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইরানের বহিস্তান শিলালিপিতে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভারতের পণ্ডিত চাণক্য (৩৭১-২৮৩ খ্রিষ্টপূর্ব) এই ‘উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার’ নিয়ে খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর জীবদ্দশায় আলোচনা করে গেছেন বিস্তর। প্রায় প্রতিটি দেশ নিজেদের প্রয়োজনে গুজব ছড়িয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়। ব্রিটিশরা তাদের চিরকালের জুজু রুশদের ভারত আক্রমণ নিয়ে গুজব ছড়াত এককালে। আর ব্রিটিশদের ছড়ানো রাশিয়াবিরোধী এই গুজবের সূত্র ধরে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জীবনের প্রথম চিঠি লিখেছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ।

ব্রিটেন এবং রাশিয়া—ইউরোপের এই দুই শক্তির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল ১৫৫৩ সালের থেকে বেশ অনেকটা সময়। ইউরোপের তৎকালীন রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ‘অ্যাংলো-রাশিয়ান সম্পর্ক’ ছিল শক্তিশালী ব্যাপার। ১৭৯০ এর দশকে ফরাসি বিপ্লবের সময় রাশিয়া-ব্রিটেন ছিল ফ্রান্সবিরোধী একই জোটে। কিন্তু ১৭৯৯ সালে নেদারল্যান্ডসে তাদের যৌথ আক্রমণ ব্যর্থ হলে রুশ-ব্রিটেন সম্পর্কের উত্তাপ থিতিয়ে যায় এবং পরস্পরের প্রতি আগের মনোভাব সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এর মধ্যে ১৮০০ সালে ব্রিটেনের মাল্টা দখলের ঘটনায় রাশিয়া ব্যাপক বিরক্ত হয়। এরপরই রুশ সম্রাট পল-১ হঠাৎ করে দীর্ঘদিনের শত্রু নেপোলিয়নের সঙ্গে একটি জোট গঠন করে ব্রিটিশশাসিত ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করে বসেন। এই নতুন পরিকল্পনা ইতিহাসে ‘ইন্ডিয়ান মার্চ অব পল’ বা ‘গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত। এ ঘটনার পর ব্রিটেন ও রাশিয়ার সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে এবং দেশ দুটি পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ভারত আক্রমণের জুজু দেখা দেয় খোদ ব্রিটেনে তো বটেই, ভারতেও। ১৮৩০-১৮৯৫ (এই সময়কে একটু বড় করে ১৮২০-১৯০৭ পর্যন্ত হিসাব করা হয়) এই কালপর্বে ব্রিটেনে শুরু হয় ‘রুশোফোবিয়া’—ব্রিটিশ প্রশাসন এবং অভিজাত সমাজ ভারতের সুরক্ষার জন্য ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এ সময়। আর রাজনীতির পুরোনো কৌশল হিসেবে ব্রিটিশরা ভারতে ছড়াতে থাকে রাশিয়াবিরোধী গুজব। এ গুজবে কান ভারী হয়ে ওঠে ভারতের সাধারণ মানুষের। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও তার বাইরে ছিল না।

‘সেভ মি ফ্রম মাই ফ্রেন্ডস’, একজন আফগানের চোখে ভালুকরূপী রাশিয়া এবং সিংহরূপী ব্রিটেন। গ্রেট গেমের সময় (১৮৩০-১৮৯৫) আঁকা একটি কার্টুন। সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস
‘সেভ মি ফ্রম মাই ফ্রেন্ডস’, একজন আফগানের চোখে ভালুকরূপী রাশিয়া এবং সিংহরূপী ব্রিটেন। গ্রেট গেমের সময় (১৮৩০-১৮৯৫) আঁকা একটি কার্টুন। সূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস

তিন ছেলের জন্ম হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথের মনে বিষয় বৈরাগ্যের উদয় হয়। এই বৈরাগ্যের কারণে তিনি নির্জনে ঈশ্বর সাধনা করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন। সেবার তিনি গিয়েছিলেন পাহাড়ে। এদিকে কলকাতা শহরে লোকে বলাবলি করছিল, আফগানিস্তান পার হয়ে রাশিয়ানরা আসছে ভারত আক্রমণ করতে। চাণক্যের দেশের মানুষ, আর গুজবে বিশ্বাস করবে না, তা তো হয় না। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে ফেলল সে গুজব। ডালপালা মেলে হাটবাজার পেরিয়ে পুরুষদের আড্ডা থেকে গুজব গিয়ে পড়ল নারী মহলে। জোড়াসাঁকোর অন্তঃপুরও তার বাইরে ছিল না। তখনকার নারীদের অক্ষরজ্ঞান বিশেষ না থাকলেও কান ছিল বেশ পরিষ্কার। লোকমুখে শোনা কথা অন্তঃপুরবাসিনীদের চিত্রকল্পে ভয়ংকর হয়ে দেখা দিল। স্বভাবতই তাঁরা পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কোনো এক ‘হিতৈষিণী’ আত্মীয়া সারদাসুন্দরী দেবীকে রাশিয়ানদের ভারত আক্রমণের গল্প শুনিয়েছিলেন। আর তা শুনে তিনি স্বামী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে পড়েন। তিনি দেবেন্দ্রনাথের খোঁজখবর করার জন্য একে-তাকে বলে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে পাকড়াও করেন বালক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখছেন, ‘... আমাকে বলিলেন, “রাসিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো”।’ মায়ের উৎকণ্ঠা বহন করে বালক রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম চিঠি লেখা। কিন্তু কীভাবে চিঠি লিখতে হয়, কোথায় ঠিকানা আর কোথায় নাম লিখতে হয় বালক রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন না। ফলে তিনি তাঁদের দপ্তরখানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হন।

সহজেই বোঝা যায়, সে চিঠিতে ‘রাবীন্দ্রিক’ ভাষার ঝলক ছিল না। ছিল জমিদারি সেরেস্তার বহুচর্বিত শুষ্ক বাংলা ভাষা। সে চিঠি দেবেন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল। তিনি খুশিও হয়েছিলেন পুত্রের চিঠি পেয়ে। উত্তরে তিনি লিখেছিলেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। রাশিয়ানদের তিনি স্বয়ং তাড়িয়ে দেবেন ভারত থেকে।

পিতার কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশ সাহসী হয়ে ওঠেন। তিনি বারবার চিঠি লিখতে থাকেন দেবেন্দ্রনাথকে। চিঠি লেখার আবেগ, বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাকুলতা সবই ছিল, কিন্তু বালক রবীন্দ্রনাথের ‘মাশুলে’র টাকাই ছিল না তখন। ফলে সেসব চিঠি বিষয় সংসারে অভিজ্ঞ মহানন্দ মুনশির হাতে পৌঁছালেও দেবেন্দ্রনাথের হাতে পৌঁছায়নি কোনো দিন।

সূত্র:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৩১১।
২. বিভিন্ন ওয়েবসাইট।