নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চক্রের হাত

দুটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি একই ব্যক্তির। তবে নাম, বাবা–মায়ের নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা সবই আলাদা। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার অনুসারে দুটি পরিচয়পত্রই বৈধ। অথচ পরিচয়পত্র দুটির মালিক একই ব্যক্তি। একটি তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন আর অন্যটি ব্যবহার করছেন প্রতারণার কাজে।

ব্যাংক থেকে আর্থিক ঋণের দুটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন তিন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। দুটি ব্যাংক থেকে প্রতারণা করে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার ঋণ নিতে তাঁরা এই পরিচয়পত্রগুলো ব্যবহার করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে জমির কাগজপত্র, ট্রেড লাইসেন্স বানানো থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই তাঁরা নিজের মূল ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে বানানো জাতীয় পরিচয়পত্রটি ব্যবহার না করে অন্য তথ্য দিয়ে বানানো পরিচয়পত্র ব্যবহার করেছেন।

তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতারণা করতে গিয়ে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর নজির তাঁরা আগেও পেয়েছেন। তবে একই ব্যক্তির একাধিক ‘বৈধ’ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার বিষয়টি এবারই প্রথম তদন্তে বেরিয়ে এল। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি বলেও তাঁরা মনে করছেন। 

ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক এবং প্রাইম ব্যাংকের করা আর্থিক ঋণের এই মামলা দুটি তদন্ত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। ওই বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে এক ব্যক্তির নামে একাধিক বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার সুযোগ নেই। জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারকেরা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে কাজ করেন এমন কিছু ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে তাঁরা এই পরিচয়পত্র বানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে একেকটি পরিচয়পত্রের জন্য খরচ হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা।

মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দুটি একই ব্যক্তির সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য বহন করছে। অর্থাৎ এক ব্যক্তির দুটি বৈধ সত্তা হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে বৈধভাবেই সে দুটো করে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে সব ধরনের দলিল বানানো যাবে। এগুলো নিরাপত্তাহীনতার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখা থেকে ৬০ লাখ এবং প্রাইম ব্যাংক মহাখালী শাখা থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেন আবুল কালাম আজাদ, আবদুল লতিফ রুবেল ও মো. সিহাব উদ্দিন নামের তিন ব্যক্তির নেতৃত্বে ১৪–১৫ জনের একটি দল। পুরো ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়াটি তাঁরা এমনভাবে সাজান যে সবকিছুই এখানে বৈধ কাগজপত্র দিয়ে করা হচ্ছে। প্রথমে তাঁরা তিনজন মিলে নামকাওয়াস্তে ৬১ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডে ‘কটনজোন’ নামের একটি অফিস ভাড়া নেন। পরে আলোচনা সাপেক্ষে শুরু হয় একটি মূল দলিল সংগ্রহের কাজ। মো. সিহাব উদ্দিনের পরিচিত সামির তালুকদারের মাধ্যমে বসুন্ধরার পূর্ব পাশে কাঁঠালদিয়া মৌজায় আবদুল আলিম নামের এক ব্যক্তির সন্ধান পায় চক্রটি। আবদুল আলিমের ৫০ শতাংশ জমি রয়েছে। এবং দলিলের ফটোকপি সংগ্রহ করেন। সিহাব উদ্দিন তখন আবদুল আলিমের নামে একটি নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র বানান।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখা থেকে ব্যাংকঋণ নেওয়ার জন্য জামিনদার হিসেবে ব্যবহার করা হয় মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র। এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আলী তাঁর মূল পরিচয়পত্রের পরিবর্তে মো. মনসুর আলী নামে বানানো জাতীয় পরিচয়পত্রটি ব্যবহার করেন। আর প্রাইম ব্যাংক মহাখালী শাখা থেকে ব্যাংকঋণ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় শামসুদ্দিন আল আজাদ নামের এক ব্যক্তির পরিচয়পত্র। এ ক্ষেত্রে তিনি হারুন অর রশীদ নামে বানানো তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রটি ব্যবহার করেন। এই তিন ব্যক্তির আলাদা ‘বৈধ’ জাতীয় পরিচয়পত্রটি বানানোর জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে যোগাযোগ করিয়ে দেন আবুল কালাম আজাদ।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, সিহাব উদ্দিন ও আবদুল লতিফ। এঁদের মধ্যে সিহাব উদ্দিন, আবদুল লতিফ এবং মো. আবদুস সালাম রাসেল নামের এক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। সিহাব ও আবদুল লতিফ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আবুল কালাম আজাদ একসময় সিটি ব্যাংকে কাজ করতেন। সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি মুদির দোকান খোলেন। এরপর কাপড়ের ব্যবসার নাম করে প্রতারণা শুরু করেন। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গোয়ালনগর গ্রামে। ঢাকায় বারিধারা এলাকায় থাকতেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এক ব্যক্তির নামে একাধিক ‘বৈধ’ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি বিস্ময়কর। এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। এক ব্যক্তি একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গেলে আঙুলের ছাপেই বিষয়টি ধরা পড়ার কথা। তারপরও যদি কমিশনের কারও যোগসাজশে এমনটা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা নিজেরা তদন্ত করে দেখবেন। মহাপরিচালক বলেন, এর আগেও অসাধু কাজের সঙ্গে কিছু ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।