দুদকের মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজার হার কমেছে

২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় কম ছিল। মামলায় অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে কম। কমেছে সাজার পরিমাণও। সংস্থার ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অবশ্য দুদক বলেছে, প্রমাণযোগ্য (পর্যাপ্ত দলিলপত্র আছে এমন) মামলা করার বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করার কারণে মামলার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। একই অবস্থা অভিযোগপত্রের ক্ষেত্রেও।

২০১৮ সালে দুদক ২১৬টি মামলা করেছে। কিন্তু ২০১৭ ও ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৭৩ ও ৩৫৯টি। একইভাবে অভিযোগপত্র অনুমোদনের ক্ষেত্রে আগের বছরের চেয়ে দুদক পিছিয়ে ছিল গত বছর। ২০১৮ সালে ২৩৬টি অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে তারা। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৮২ এবং ২০১৬ সালে ৫৩৫টি।

জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, মামলার গুণগত মানের সঙ্গে কমিশন মোটেও আপস করবে না। তাই অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে প্রমাণের প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করা হয়েছে। দলিলপত্র ও সাক্ষ্য–প্রমাণকে আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাই মামলা-মোকদ্দমা বা প্রতিরোধমূলক কাজের পরিমাণ কিছুটা কম মনে হচ্ছে।

গত তিন বছরে দুদকের গ্রেপ্তার অভিযান বেশ আলোচনায় এসেছে। কিন্তু গত বছর গ্রেপ্তারের পরিমাণ কম ছিল। দুদকের তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয় ৩৮৮ জনকে। ২০১৭ সালে ১৮২ জন, ২০১৮ সালে ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বছরের অক্টোবরে সরকারি কর্মচারী আইন পাস হওয়ার পর দুদকের গ্রেপ্তার অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়ে। এ আইন থাকার কারণে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা যাবে কি যাবে না, সেই বিতর্কের মধ্যে ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এর কিছুদিন পর ২৪ জানুয়ারি দুদকের এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন আনসার-ভিডিপির জেলা কমান্ড্যান্ট।

২০১৮ সালে দুদকে লিখিত অভিযোগ আগের বছরের তুলনায় কম এসেছে। এসব অভিযোগের একটি বড় অংশ দুদকের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় সেগুলো আমলে নেয়নি তারা। কিছু অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে সেগুলোর ওপর ব্যবস্থা নিয়ে দুদককে জানাতে বলা হয়েছে।

>

২০১৮ সালে দুদক ২১৬টি মামলা করেছে
২০১৭ ও ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৭৩ ও ৩৫৯ টি
২০১৮ সালে ২৩৬টি অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুদক
২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৮২ টি, ২০১৬ সালে ৫৩৫ টি

দুদক মনে করছে, তাদের হটলাইন চালু হওয়ার পর লিখিত অভিযোগ দেড় হাজার কম এসেছে। বিনা খরচে এবং যেকোনো মোবাইল বা টেলিফোন থেকে ১০৬ নম্বরে ফোন করে দুদককে দুর্নীতির তথ্য, অভিযোগ জানানো যায়। দুদক জানিয়েছে, তাদের হটলাইনে ২০১৮ সালে ১৭ লাখের বেশি অভিযোগ এসেছে। হটলাইনে পাওয়া অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি অনেক সরকারি দপ্তরে হানা দিয়েছে। অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে সরকারি সংস্থার সিবিএ নেতাদের দখলে থাকা বিলাসবহুল গাড়িও। ২০১৮ সালে হটলাইনে আসা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে ১৪৪টি অভিযান চালিয়েছে সংস্থার এনফোর্সমেন্ট দল।

গত তিন বছরে ৫২টি ফাঁদ পেতে ৫২ জন সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ফাঁদ পাতার ঘটনা ছিল ১৫টি, ২০১৭ সালে ছিল ২৪টি।

কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্নীতি মামলায় সাজার ক্ষেত্রেও সংখ্যাটি নিম্নগামী। ২০১৮ সালে ৬৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৬৮ শতাংশ। তবে বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলা আগের বছরের ৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে ৫০ শতাংশ হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর দুদককে সেভাবে সক্রিয় দেখা যায়নি। নিয়ন্ত্রণমূলক কাজের চেয়ে প্রতিরোধমূলক কাজে সক্রিয় ছিল বেশি। তারা যেসব মামলা বা অনুসন্ধানে সক্রিয় ছিল, সেগুলো মূলত মধ্যম ও ছোটখাটো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি। ব্যাংক খাতের মতো আলোচিত অনেক বিষয়েই তারা সক্রিয় ছিল না।

প্রতিবেদনের সুপারিশ

গতকাল সোমবার বিকেলে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে সংস্থাটি। দুদকের পর্যবেক্ষণ হলো সরকারি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ক্রটির কারণেই অধিকাংশ দুর্নীতি সংঘটিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় সেবায় বিঘ্ন ঘটে। তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা। এ কারণে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোতে দৈনন্দিন কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও কাজে গতিশীলতা আনার পরামর্শ দিয়েছে দুদক।

পাশাপাশি সরকারি দপ্তর ও সেবা সংস্থাগুলোর দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশও করেছে দুদক। দুর্নীতি-অনিয়ম বা হয়রানি থেকে উত্তরণের জন্য প্রায় ১২০টি সুপারিশ ওই প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সরকারি দপ্তরেই সেবা প্রদান প্রক্রিয়া বেশ জটিল। সেসব জটিল প্রক্রিয়ার কারণে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে দুদক যদি যথাযথ সুপরিশ করে, সেগুলো পরিবর্তন ও সহজ করা যথার্থ হবে।