তারাগঞ্জে ২০ দিনে ১০ বাল্যবিবাহ

>

গত ১৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত এই বাল্যবিবাহগুলো হয়। এসব বিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না বলে জানান অভিভাবকেরা।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ৯টি গ্রামে ২০ দিনে ১০ জন স্কুলছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত এসব বিয়ে হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসন তেমন তৎপর নয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শাহানাজ ফারহানা বলেন, ‘আমরা তো বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছি। খবর পেলেই প্রশাসনের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ রোধ করছি। তারপরেও গোপনে বাল্যবিবাহ হলে আমরা করব কী? খবর না পেলে কী করব?’

এ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ৩৫টি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা রয়েছে। গত ২০ দিনে এসব প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। এসব বিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা ছিল না বলে জানিয়েছেন সচেতন অভিভাবকেরা।

জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো স্কুলে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের বোঝাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝলেও অভিভাবকেরা বুঝতে চান না। ভালো পাত্র পেলে তাঁরা রাতের আঁধারে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার থাকে না।’

শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪ মে সরকারপাড়া গ্রামে নবম শ্রেণির এক মেয়ের বিয়ে হয়। ৩০ এপ্রিল মাঝাপাড়া গ্রামে একই শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ের বিয়ে হয়। ২৭ এপ্রিল কসাইপাড়া গ্রামে দশম শ্রেণির এক মেয়ের বিয়ে হয়। ২৩ এপ্রিল বেলালেরপাড়া ও জুম্মাপাড়া গ্রামে একই শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ের বিয়ে হয়। ২০ এপ্রিল ছুট মেনানগর গ্রামের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে হয়। ১৮ এপ্রিল মেনানগর ও মাটিয়ালপাড়া গ্রামের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ের বিয়ে হয়। ১৫ এপ্রিল পোদ্দারপাড়া গ্রামের দশম শ্রেণিপড়ুয়া এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এমন দুজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মেয়েদের বয়স বেশি হলে ও লেখাপড়া বেশি শেখালে শিক্ষিত বর দরকার হয়। সে ক্ষেত্রে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। অল্প বয়সে ভালো বর পাওয়া যায়। তা ছাড়া গাঁয়ের পরিবেশ ভালো না। বেশি বয়সের মেয়ে বাড়িতে রাখতে ভয় লাগে। তাই বাল্যবিবাহ দিয়েছেন তাঁরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাল্যবিবাহ দেওয়ার কারণে অনেক মা ও শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। অনেক সময় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনেকে চিকিৎসা নিতে আসেন।

গত মঙ্গলবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাঠে কথা হয় বাল্যবিবাহের শিকার মনিকা খাতুন ও তার মা হোসনা বেগমের সঙ্গে। হোসনা বেগমের বাড়ি ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে দেন তিনি। ১৫ বছর বয়সে সন্তান জন্ম দিয়ে তার শরীর ভেঙে গেছে।

হোসনা বেগমের পাশে ছিলেন মেনানগর গ্রামের আফজাল হোসেন। তিনিও ১৫ বছরের মেয়ে আফরুজা খাতুনকে বাল্যবিবাহ দিয়েছেন। মেয়ে ও এক বছরের নাতিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘অল্প বয়সে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে কী যে ভুল করেছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। বিয়ের এক বছরের মাথায় বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েটার অসুখবিসুখ লেগেই আছে। চিকিৎসা করাতে প্রচুর খরচ হচ্ছে।’

মেনানগর গ্রামের গৃহবধূ রিক্তা বেগম বলেন, ‘১৪ বছর বয়সে মোর বিয়া হইছে। ১৫ বছর পাঁচ মাস বয়সে ছোয়া (সন্তান) হওয়ার পর মোর শরিল ভাঙি গেইছে। কাম করবার না পাওয়ায় মোর স্বামী-শাশুড়ি মোক এলা জ্বলায়ছে। সাত দিন আগোত হাসপাতালোত গেছনু। তা ডাক্তার কাজলী আপা দেখি কইছে, ছোটতে বিয়া হওয়ায় মোর শরিলের এই দশা হইছে। মোর ছোয়াটার শরিলোতও ভিটামিনের অভাব আছে। সেই জন্যে ছোয়াটাও খাবার চায় না। খালি কান্নাকাটি করে।’

উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, বাল্যবিবাহ ও বিয়ের পর সন্তান হলে মায়ের শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। সন্তান পুষ্টিহীনতায় ভোগে। মায়ের অসুখবিসুখ লেগেই থাকে। তাই ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়া ঠিক না।

জানতে চাইলে ইকরচালী ও কুর্শা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার মিন্টু মিয়া বলেন, ‘আমি বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রি করি না। অভিভাবকেরা বিয়ে পড়ানোর আগে বর-কনেকে অন্য এলাকার কাজির কাছে নিয়ে গিয়ে নকল জন্ম সনদ দেখিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করাচ্ছেন। অনেকে নোটারি পাবলিকের অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে দিচ্ছেন।’

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বলেন, ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়া বেআইনি। এ উপজেলায় এত বাল্যবিবাহের বিষয়টি জানা ছিল না। এখন পরিকল্পনা করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।