দারিদ্র্য ওদের দমাতে পারেনি

নাসরিন আক্তার, আবুল হোসেন, মারুফ ইসলাম, আয়েশা সিদ্দিকা
নাসরিন আক্তার, আবুল হোসেন, মারুফ ইসলাম, আয়েশা সিদ্দিকা

কারও বাবা বাসচালকের সহকারী, কেউ নিজেই মজুরির কাজ করে, কারও ভাই দিনমজুর, ভূমিহীন কৃষকের সন্তান কেউ। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুবেলা খাবার জোটাতেই তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। এসব পরিবারের কাছে বিদ্যাচর্চা বিলাসিতার অপর নাম। তবু তারা হাল ছাড়েনি। আত্মশক্তিকে হাতিয়ার করে লেখাপড়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম চালিয়ে জয়ী হয়েছে এই অদম্য মেধাবীরা। এবার মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা।

নাসরিনকে এখন গ্রামের মানুষ দেখতে আসে

নাসরিন আক্তারের বাবা রশিদ আলী হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক বছর ধরে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। বড় ভাই কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। তিনিও কাজকর্ম খুব একটা করতে পারেন না। ছোট ভাই মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ করে। তবে উপার্জন খুব একটা হয় না। খেয়ে না–খেয়ে চলে সংসার। এর মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে নাসরিন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসিতে বৃত্তি পেয়েছিল সে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার কালিয়াকৈর খান উচ্চবিদ্যালয় থেকে সে এবার এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

তার বাড়ি উপজেলার গাড়াদিয়া গ্রামে। তার মা তহুরন বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসারে পেটে ভাত জুটে নাই। ম্যায়া আমার একটা ভালা কাপড় পিনতে পারে নাই। পড়ালেহা চালায়া গেছে। অন্যের কাছ থেকে বই ধার কইর‍্যা পড়ছে। এখন পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। গেরামের মানুষ ম্যায়ারে দেখতে আহে। এডাই শান্তি। ম্যায়ার কলেজে ভর্তি আর পড়ালেহা কেমনে চলবে, হেই চিন্তাও অয়।’

 বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দুলাল হোসেনের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ নাসরিন। তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। প্রাইভেট পড়িয়ে তার কাছ থেকে টাকা নেননি।  

দিনমজুরি করে পড়াশোনা চালিয়েছে আবুল হোসেন

নাম তার আবুল হোসেন। বাড়ি কালিয়া উপজেলার নওয়াগ্রামে। পাঁচ ভাইবোন। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বড়। ছোট ভাই ইমন পড়ে দশম শ্রেণিতে। বাবা বরকত হোসেন ছিলেন যাত্রীবাহী বাসের চালকের সহকারী। তিনি নানা রোগে ভুগে এক বছর ধরে বিছানায়। তাঁদের জমিজমা নেই। আবুলের পড়াশোনার খরচ দিতে পারেননি। টিউশনি করে আর কখনো কখনো দিনমজুরি করে পড়াশোনার খরচ চালাত সে। পরিবারের অন্য সদস্যের মুখের অন্নের সংস্থানও তাকে করতে হয়। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আবুল হোসেন এবার নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শাহাবাগ ইউনাইটেড একাডেমি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে পিইসি ও জেএসসিতে বৃত্তি পেয়েছিল।

আবুল হোসেনের মা শেফালি বেগম ছলছল চোখে বলেন, ছেলে তাঁর এত পরিশ্রম করে দেখে তাঁর বুক ফেটে যায়। তিনি অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আবুল দেয়নি।

মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন, সে মজুর খাটে

মারুফ ইসলামের বাবা এমদাদুল ইসলাম দিনমজুরি করতেন। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। আর মারুফের মা মাহামুদা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাতে যা আয় করেন, তা দিয়ে চার সদস্যের ঠিকমতো দুই বেলার খাবার জোটে না। সংসার ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে মারুফ কখনো কৃষিশ্রমিকের কাজ করে, আবার কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যেও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে। এবার সে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।  

মারুফের বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলার সরকারপাড়া গ্রামে। সে বলে, ‘আমার বাবা অসুস্থ। মায়ের আয়ে সংসার চলে না। তাই সংসার ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে আমাকে দিনমজুরির কাজ করতে হয়েছে। তাতে দুঃখ নাই। তবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই। অভাবের সংসারে তা সম্ভব হবে কি না, এই দুশ্চিন্তাও তাড়া করে।’

প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানতাম ছেলেটা ভালো ফল করবে। কিন্তু এত ভালো করবে তা কল্পনাও করতে পারি নাই।’

কত দিন কিছু না খেয়ে বিদ্যালয়ে গেছে সে

চাষের জমি নেই। ভিটেমাটিটুকুই সম্বল। বিদ্যালয়ের বারান্দায় তার মা হালিমা খাতুন ছোলা-বাদাম বিক্রি করেন। বাবা হাতেম আলী ভ্যান চালান। সংসারে নিত্য অভাব। এর মধ্যেই পড়াশোনা করেছে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ফকিররাস্তা গ্রামের আয়েশা সিদ্দিকা। সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় মনিরামপুরের নাগোরঘোপ এমএল উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে। এর আগে পিইসি ও জেএসসিতে সে বৃত্তি পেয়েছিল। তার ছোট একটি ভাই আছে। একই বিদ্যালয়ে সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালাতে মা-বাবার নাভিশ্বাস উঠছে। মেয়ের কলেজে পড়াশোনার খরচ বহন করা নিয়ে তাঁরা দুচিন্তা করছেন।

আয়েশা বলে, ‘অনেক দিন সকালে না খেয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। খাতা-কলম কেনার টাকা বাবা ঠিকমতো দিতে পারেননি। তারপরও আমি লেখাপড়া চালিয়ে গেছি।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ, নড়াইল ও তারাগঞ্জ, রংপুর এবং যশোর অফিস]