ছেলে তাঁর ভেসে গেছে দূর সমুদ্র জলে

ফাহাদ আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
ফাহাদ আহমদ। ছবি: সংগৃহীত

মায়ের কান্না থামছেই না। তিনি কথা বলছেন, আর কাঁদছেন। আর কিছুক্ষণ পরপর মূর্ছা যাচ্ছেন। বুকের ভেতরে উথলে ওঠা এ কান্না থামানোর যে কোনো পথ নেই। বছর দেড়েক আগে মায়ের কোল ছেড়ে ছেলে গিয়েছিলেন দূরদেশে। একটা ভালো জীবনের আশায়, একটা সচ্ছল জীবনের স্বপ্নে। তবে আজ আর কিছুই হাতের নাগালে নেই। না ছেলে, না সচ্ছল জীবন। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছে ছেলে ফাহাদ আহমদের (১৮) নাম। ছেলে তাঁর ভেসে গেছে দূর সমুদ্র জলে, লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি।

বুধবার ফাহাদের মা আয়েশা আক্তারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। গুছিয়ে কথা বলতে পারছেন না তিনি। কান্নার ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মায়ের কথাগুলো। যেমন সমুদ্রের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়েছে তাঁর ছেলে। আয়েশা আক্তার বলেন, ৮ মে রাত আটটায় ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। সে সময় ছেলে মাকে বলেছিলেন, ‘আমারে যে টেখা (টাকা) দিছো, একটাও আমি খাইছি না। আমার কইলজা জ্বলেরে (জ্বলে যাচ্ছে)। মাইগো (মা), আমি যাইরামগি (চলে যাচ্ছি)। আমার লাগি দোয়া করিও।’ আয়েশা বলেন, ‘ওই দিন রাইত (রাত) একটায় তাঁর (ছেলের) মামারে লিখছে মামা আমি বোটে। এরপর থাকি আর তাঁর লগে (সঙ্গে) কোনো যোগাযোগ নাই।’

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসী প্রত্যাশীদের নৌকাডুবিতে যে কজন নিহত হয়েছেন, ফাহাদ আহমদ তাঁদের মধ্যে একজন। গত সোমবার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁর নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ফাহাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বের চক এলাকায়। তাঁর বাবা তাজুল ইসলাম আহাদও একজন প্রবাসী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে ফাহাদ সবার বড়। প্রবাসে যাওয়ার আগে ফহাদ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

ফাহাদের মা ও মামা সাব্বির আহমদ বুধবার প্রথম আলোকে জানান, বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোয়ালি এলাকার তাঁদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়, নাম নাসির উদ্দিন। নাসিরই ফাহাদকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। পরিবার চায়নি ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ছেলে ইতালি যাক। কিন্তু নাসির তাঁদের বাড়ি এসে নানা ভাবে বুঝিয়ে ফাহাদকে রাজি করায়। নাসির সে সময় বলেছিলেন, ‘সাগর দিয়ে গেলেও কোনো সমস্যা হবে না। ওকে জাহাজে পাঠানো হবে। এতে ভয় করার কিছু নেই।’ ফাহাদ তখন মায়ের হাত-পা ধরে অনেকটা জোর করেই রাজি করিয়েছিলেন।

ফাহাদের পরিবার জানায়, আট লাখ টাকার বিনিয়মে ফাহাদকে ইতালি পাঠানোর চুক্তি হয়। নগদ দুই লাখ এবং বাকি টাকা অনেকের কাছ থেকে ধার দেনার মাধ্যমে জোগাড় করা হয়। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর ফাহাদ ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর দুবাই, তুর্কি হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। লিবিয়াতে পৌঁছার তিন মাস পরে একবার সাগর পথে ইতালির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছিল ফাহাদকে। কিন্তু তখন ধরা পড়ে যাওয়ায় ফাহাদকে লিবিয়াতেই থাকতে হয়। এত দিন ফাহাদকে দেশে ফেরাতে নাসিরকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। নাসির তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন বলে আশ্বাস দেন। এর কিছুদিন পরপরই ভিডিও কলে ফাহাদের দিকে বন্দুক ধরে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সন্তানের প্রাণের ভয়ে মা আয়েশা আক্তার প্রতিবেশীর কাছে দুই বছরের শর্তে বাড়ি বন্ধক দেন। একে একে ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তিনি। কিন্তু এখন তাঁর ছেলে আর কখনো বাড়ি ফিরবে না।

আয়েশা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওখন কিতা করতাম (কী করব)। আমি পোয়ারে (ছেলেকে) পাঠাইতে চাইছলাম না। অখন আমার বাইচ্চা (ছেলে) আছে কি না, জানি না। স্বামীও বেমারি (প্রবাসী)। তিনটা বাইচ্চা নিয়া বাড়ি ছাড়িয়া রাস্তাত। না খাইলাম পানি, না খাইলাম দানা, অনাহারে জীবন কাটাইলাম (কাটাচ্ছি)।’

ফাহাদের মামা সাব্বির আহমদ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাগনে খুব সরল সোজা ছেলে। নাসির আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ফাহাদকে খুব বেশি উসকানি দিত। ১০ দিনের মধ্যে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছে। প্রথমে আট লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। পরে লিবিয়া থেকে ভিডিও কল করে বন্দুক ধরে বলা হতো, টাকা পাঠাও। তখন বাড়ি বন্ধক দিয়ে ১৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা বিভিন্ন টেলিভিশনে নিউজ দেখছি। কিন্তু এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। ছেলেও গেল। বাড়িও গেল।’

এই ঘটনার সঙ্গে বারবার নাসির উদ্দিনের নাম চলে আসায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।