কক্সবাজারে অরক্ষিত শিবির, পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা

আশ্রয়শিবির থেকে মালয়েশিয়ায় পাচারের সময় পুলিশের হাতে উদ্ধার রোহিঙ্গা তরুণী। গত ২৮ এপ্রিল টেকনাফের সাবরাং এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
আশ্রয়শিবির থেকে মালয়েশিয়ায় পাচারের সময় পুলিশের হাতে উদ্ধার রোহিঙ্গা তরুণী। গত ২৮ এপ্রিল টেকনাফের সাবরাং এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ বছরের ৫ মে পর্যন্ত সময়ে শিবির থেকে পালানোর সময় ৫৮ হাজার ৫৮৩ জন রোহিঙ্গা আটক।

কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। দিনে কিংবা রাতে, যেকোনো সময়—অবাধে চলছে পলায়ন। শিবিরের চারদিকে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় রোহিঙ্গাদের পালানো ঠেকাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে (নৌকায়) মালয়েশিয়ায়, কেউ কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে নিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, কেউ আবার কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বসবাসের জন্য শিবির ছেড়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের পালানোর কারণের মধ্যে রয়েছে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়া, মিয়ানমারে ফিরে গেলে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পাওয়া, ফেলে আসা ঘরবাড়ি-সম্পদ ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কা। এ ছাড়া শিবিরে কায়ক্লেশের জীবন ছেড়ে বাইরে ‘উন্নত’ জীবনের হাতছানিতে পা বাড়াচ্ছে অনেকে।

সর্বশেষ ১২, ১৩, ১৪ মে মালয়েশিয়ায় পাচারের সময় পুলিশ টেকনাফ, মহেশখালী ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে ১০৩ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে। মাথাপিছু ২০-২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে দালাল চক্র উখিয়া ও টেকনাফের শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যায়। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিশোরী বেশি।

গত শুক্রবার রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার একটি বাসা থেকে ২৪ রোহিঙ্গাসহ ২৬ জনকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় ৫৬টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। আটক ২৪ রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে টেকনাফের শিবির থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে কক্সবাজারের পুলিশ।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ মাসে (২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ বছরের ৫ মে পর্যন্ত) উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবির থেকে পালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৫৮ হাজার ৫৮৩ জন রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৮২ জনকে আটক করা হয় চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, চাঁদপুরসহ ১৭ জেলা থেকে।

অপর দিকে গত ১ মার্চ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত সময়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিজিবি, পুলিশ ও কোস্টগার্ড সদস্যরা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে ১৫ দফায় ১৭০ নারী, ১০৭ পুরুষ, ৮৫ শিশুসহ ৩৬২ জন রোহিঙ্গা ও ২ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন। এসব ঘটনায় ১৩ জন দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত বুধবার উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, লম্বাশিয়া ও মধুরছড়া ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক শ রোহিঙ্গা শিবির ছেড়ে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর তারা বাসে উঠে রওনা দিচ্ছে কক্সবাজারের দিকে। এ সময় তাদের বাধা দিতে কাউকে দেখা যায়নি। বাজারে কেনাকাটার কথা বলেও রোহিঙ্গারা বাজারে এসে নিরুদ্দেশ হচ্ছে।

অরক্ষিত শিবির

১১ লাখ ১৮ হাজার ৯৫১ জন রোহিঙ্গার ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের কোনোটি ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নেই। শিবিরের আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর। অরক্ষিত শিবিরগুলোর চারদিকে এক হাজারের বেশি জঙ্গলঘেরা দুর্গম হাঁটাপথ রয়েছে। এসব পথ দিয়ে রোহিঙ্গারা যখন-তখন আশ্রয়শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন সড়কে ৭টি তল্লাশিচৌকি বসিয়েও রোহিঙ্গাদের পালানো ঠেকাতে পারছে না পুলিশ।

পুলিশ জানায়, শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে মাত্র ৯৫০ জন পুলিশ। দুটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের মধ্যে ইতিমধ্যে একটি স্থাপিত হলেও রয়েছে জনবল সংকট।

পুলিশ জানায়, রোহিঙ্গাদের ভাষা ও চেহারা স্থানীয়দের মতো। এ কারণে তল্লাশিচৌকিগুলোতে তাদের শনাক্ত করতে পারে না পুলিশ। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের অনেকে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখে। পরিচয়পত্র আসল না নকল, তল্লাশিচৌকিগুলোতে তা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নেই।

সমাধান কোথায়?

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হলে রোহিঙ্গাদের যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়া রোধ হতে পারে। ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের’ সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের কাজে–কর্মে নিয়োগ, বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের নজরদারিতে রাখতে হবে।