জিপিএ-৫ পাওয়া দুই আয়েশা পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায়

মা-বাবার সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা। ছবি: প্রথম আলো
মা-বাবার সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা। ছবি: প্রথম আলো

আয়েশা সিদ্দিকা ও আয়েশা সিদ্দিকা আক্তার। দুজনই চলতি বছরে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ডাংগীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ ঘরের দুই আয়েশাই পেয়েছে জিপিএ-৫।

দুই আয়েশার মধ্যে নামের যেমন মিল, স্কুলের মিল। তেমনই মিল তারা দুজনই জেএসসিতেও পায় জিপিএ-৫; বাড়িও একই ইউনিয়নে।

পরিবার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই আয়েশার জীবনসংগ্রামের কথা। গল্পগুলো এমন—চার ভাইবোনের সংসারে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে লেখাপড়া চালিয়েছে আয়েশা সিদ্দিকা। আর আয়েশা সিদ্দিকা আক্তার তার পড়াশোনা চালিয়েছে গ্রামের শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে; মা করেন ঝিয়ের কাজ।

আয়েশা সিদ্দিকার বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের মেনানগর কোরানিপাড়া গ্রামে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিনও তাকে নিজ ঘরে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা জেনেও স্কুলের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে যোগ দিতে পারেনি। আয়েশাদের সংসারের অবস্থা এমনই যে, খাতা ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে সে কম কম লিখত; পড়ত বেশি বেশি।

আয়েশা সিদ্দিকা চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। তাদের সহায়সম্বল বলতে বসতভিটাসহ ৩০ শতক আবাদি জমি ও ছোট দুটি টিনের ঘর। তার বাবা ছয় বছর আগে অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। মায়ের আয়ে সংসার চলে না। স্কুলের শিক্ষকের পরামর্শে নিজ বাড়িতে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শুরু করে আয়েশা।

আয়েশা সিদ্দিকার ভাষ্য, ‘বাবা ছয় বছর ধরে হৃদ্‌রোগে ভুগছেন। কোনো কাজ করতে পারেন না। মায়ের আয় দিয়ে দুই বেলার খাবার জোটে না। তাই কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে এত দূর এসেছি। আমার ইচ্ছে শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু জানি না অভাবের সংসারে এ স্বপ্ন কতটুকু সফল হবে!’

বাবার সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা আক্তার। ছবি: প্রথম আলো
বাবার সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা আক্তার। ছবি: প্রথম আলো

আয়েশার বাবা আবদুস সালাম বলেন, ‘মেলা দিন মেয়েটা মোর খালি পেটে স্কুল গেইছে। শুনুছুং ওয় ভালো রেজাল্ট করচ্ছে। কিন্তুক হামার তো দুই বেলা খাবার জোটে না, ছাওয়াটাক ফির কেমন করি লেখাপড়া শিখাই কন?’

হাড়িয়াকুঠি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মেনানগর কোরানিপাড়া গ্রামের আয়েশা সিদ্দিকার বাবা আবদুস সালাম অসুস্থ। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ। পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় মেয়েটাকে কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছিলাম।’

এদিকে আয়েশা সিদ্দিকা আক্তারের বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের আদাহিন্না গ্রামে। তিন বোনের সংসারে সে সবার বড়। বাবা জহুরুল ইসলাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ। মা মর্তুজা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।

আয়েশা সিদ্দিকা আক্তারের মা মর্তুজা বেগমের ভাষ্য, ‘পাড়ার মানুষ কয়ছে মোর মেয়েটা খুব ভালো এজাল (রেজাল্ট) কচ্ছে। শুনি মোর বুকটা ফাটি জাওছে। কিন্তু মোর তো হইল জঞ্জাল। এত্তদিন মুষ্টির চাল তুলি থুইয়া তাক বেঁচে বাড়ির পাশের স্কুলোত মেয়েটাক পড়ানু। অ্যালা দূরের কলেজোত ক্যামনে ভর্তি করাইম কন? পড়ারে বা টাকা কোনটে পাইম।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সংগ্রামী এই নারী।

হাড়িয়ারকুঠি ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আদাহিন্না গ্রামের আয়েশাদের সহায়সম্বল বলতে ২০ শতক জমি। তার বাবা জহুরুল ইসলাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এ কারণে লোকজন কাজে নেয় না। এসএসসি পরীক্ষার আগে আয়েশাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। আয়েশার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে তার বাবাকে পরিষদে ডেকে এনে পড়াশোনা করানোর পরামর্শ দিই।’

আয়েশা সিদ্দিকা আক্তার বলে, ‘আমার ইচ্ছা ডাক্তার হওয়া, কিন্তু আমাকে লেখাপড়া করানোর সাধ্য বাবা-মার নেই।’ আয়েশার বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্যাটোত ভাত জোগাড় করবার পড়ি না। ছাওয়াটাক ফির আরও উপরের ক্লাসোত পড়ামো ক্যামন করি।’

ডাংগীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই আয়েশার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সবার সহযোগিতা পেলে মেধাবী এই দুই মেয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আয়েশা সিদ্দিকাকে সেলাইয়ের কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম। সে সেই পরামর্শ কাজে লাগিয়ে এত্ত দূর এসেছে।’

তাদের সহায়তা করতে চাইলে—আয়েশা সিদ্দিকার বিকাশ নম্বর: ০১৭৫০৩০৬৩৯৯ এবং আয়েশা সিদ্দিকা আক্তারের বিকাশ নম্বর: ০১৩০৫১৫৬৮৪৬।