আ.লীগের মনোযোগ সংগঠনে, দল সামলাতে হিমশিম বিএনপি

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন উল্লেখ করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপি। বহু নাটকীয়তা পর এবং দল-জোটের সমালোচনার মুখে বিএনপির একজন ছাড়া সবাই সাংসদ হিসেবে শপথ নেন। এর পরই দলটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদের বিষয়টি সামনে এসেছে। দল গোছাতে গিয়েও বেগ পেতে হচ্ছে দলটির নেতাদের।

অন্যদিকে ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ নিচ্ছে সম্মেলনের প্রস্তুতি। কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত বিভাগীয় ও জেলা সদরে সাংগঠনিক সফরে। সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ না থাকায় রাজনীতির মাঠে এবং সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ এখন দৃশ্যত একচ্ছত্র অবস্থান বজায় রেখেছে।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘অবৈধ’ সরকার উপাধি দিয়েছিল। ওই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা গেছে। যার কারণে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ নেতাদের আহ্বান আর বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের দাবির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফল কী হয়েছে, সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্য সমালোচনা আছে। তবে ওই নির্বাচনে গিয়ে এবং শপথ নেব না বলেও শেষ পর্যন্ত শপথ নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে ।

জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিংবা না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি অনেক পানি ঘোলা করেছে। এরপর নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দোষারোপ করে সারা দেশের কোথাও কোনো বিএনপি নেতা মাঠে নামতে পারেননি। অনেকে মাঠে নামার সামান্য আগ্রহও দেখাননি। এ অবস্থায় নির্বাচনে নজিরবিহীনভাবে হেরে গিয়ে ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। কিন্তু নিজেদের দাবি করা ‘প্রহসনের নির্বাচন’-এর মাধ্যমে গঠিত সংসদে যোগ দেয় দলটি।

বিএনপির সংসদে যাওয়া ভুল সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদ। গত বুধবার প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সংসদে গেছে, এটাই হলো বাস্তবতা। বিএনপি সংসদে গিয়ে এ সরকারকে বৈধতা দিয়েছে, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’ সাবেক এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, ‘বিএনপির নেতাদের অনুরোধ করব, আপনারা নেতৃত্ব দেন। তা না হলে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। এক জায়গায় একত্র হোন। আমাদের হাতকে শক্তিশালী করুন। তা না হলে আপনাদের হাত শক্তিশালী করার জন্য আমাদের বলেন, আমরা সেটা করতে রাজি। বসে থাকলে চলবে না।’

নির্বাচন মেনে নেওয়া এবং সংসদে যোগ দেওয়াতে দলটির নেতাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা গেছে। যে কারণে অনেকে দলের সাংসদদের শপথ নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন শপথ নেওয়ার বিষয়টি দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। বিএনপির সাংসদের শপথের ব্যাপারে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যাঁরা শপথ নিয়েছেন বা নেবেন, তাঁরা গণদুশমন হিসেবে বিবেচিত হবেন।

বিএনপির নেতৃত্ব যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল এবং তাদের সিদ্ধান্তের জায়গাটি স্পষ্ট ছিল না, সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় দলটির মহাসচিবের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমরা অতীতে বলেছিলাম যে আমরা যাব না। সেই সিদ্ধান্ত ওই মুহূর্তে সঠিক ছিল না।’ তিনি তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ভুল ছিল বলে স্বীকার করে নেন।

সংসদে যোগ দেওয়ার পর বিএনপিতে বিভেদ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলটির নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। দলের নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এমন কথাও অনেকে বলেছেন। এ ছাড়া দলটি বিভিন্ন জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিচ্ছে। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেকে বিক্ষোভ করছেন। অনেক জেলায় কমিটি আবার পর্যালোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এসব কারণে এখন বিএনপির দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দলটির নেতা রুহুল কবির রিজভীর নিয়মিত ব্রিফিং এখন বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ঝামেলার মধ্যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা খালেদা জিয়া নেই। আর ওখান (লন্ডন) থেকে বসে তারেক রহমান দল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, যেটা একটি ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, এত দিন একটি দল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারছিল না, তারাও এখন সক্রিয় হয়েছে। এখন একটি দল ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে লেগে গেছে। সবকিছুর মধ্যে এখন আওয়ামী লীগকে উদ্যোগী হতে হবে। না হলে ‘শনির দশা’ দেশের জন্য অপেক্ষা করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে ব্যস্ত দল গোছানোর কাজে। আগামী অক্টোবরে দলটির কেন্দ্রীয় সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্মেলন সামনে রেখে দলের তৃণমূলের বিভিন্ন অসম্পূর্ণ কমিটি সম্পূর্ণ করার জন্য কেন্দ্র থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে সাংগঠনিক সফরের জন্য কয়েকটি দলে বিভক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। এই নেতারা বিভাগীয় ও জেলা সদর সফর করে তৃণমূলকে গুছিয়ে নেবেন।

দল গোছানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি তার নিজের গতিতে চলে। প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই। বিএনপি নিজেদের রাজনীতির কারণে আজ এই দুর্দশায় পড়েছে। এখানে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে লাভ নেই, সেই সুযোগও নেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার জন্য তৃণমূল গোছানো শুরু করেছে। নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন হবে বলে আশা করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের সামনে এখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। দলটি নির্বিঘ্নে দেশ পরিচালনা করছে। বিদেশিদেরও প্রত্যক্ষ কোনো চাপ সরকারের ওপর নেই। রাজনীতির মাঠও সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বিএনপির চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতেও রাজপথে বিএনপির কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে রাজনীতি এখন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেই।