বীরদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

‘...আমি পূর্ব-পশ্চিম শুতেই মেশিনগান-স্টেনগানের ঠাস ঠাস করে শব্দ হল। বোমা আসে হারুনুর রশিদের কোমরের ওপর পরতেই খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল এবং এক টুকরা আইসে আমার হাঁটুর ওপর পড়ল। ওইটাই আমার মনে আছে। আমি দুই দিন হাসপাতালে ছিলাম। হারুনুর রশীদ যখন মারা যায় তখন মুখে দাঁড়ি ছিল, ওনার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণ। ওর আবার বয়স কম ছিল, এ জন্য ওর সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতাম। উনি কোন জায়গার, কোন থানার, আমার জানা নাই, কিন্তু তাঁর কথা এখনো মনে আছে।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন একাত্তরের বীর সেনানী মো. লাল মিয়া। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার এই মুক্তিযোদ্ধার এই বয়ান উঠে এসেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের শ্রুতিকথা: গাবতলীর সূর্যসন্তানেরা’ শীর্ষক বইয়ে।

একই বইয়ে উঠে এসেছে গাবতলীর আরেক মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহীম আলীর যুদ্ধে যাওয়ার আবেগময় বর্ণনা—‘...২৫ শে মার্চের পরে ভাবলাম আমাদের তো এই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হবে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। বন্ধু-বান্ধবসহ সংগঠিত হই...বাবা-মাকে বলিনি যে, আমি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভারতে গেছি। আমার বাবা-মাকে বলার সময় পাইনি। আমি বাজার গেছিলাম। বাজার থেকে এসে মাকে বললাম, মা ভাত হইছে? মা বলল, না বাবা ভাত হয়নি। তখন আমি মাকে বললাম যে, মা, ভাত আর আমার খাওয়া হল না। তাই কয়া আমি লুঙ্গি, শার্ট আর গোটা পঞ্চাশেক টাকা নিয়া চইলা গেলাম।’

গাবতলীর এমন ২১২ জন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা সংকলিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের শ্রুতিকথা: গাবতলীর সূর্যসন্তানেরা’ শীর্ষক বইটিতে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বয়ানে উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, ত্যাগ, কষ্ট এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হত্যাযজ্ঞ-নির্যাতনের কথা। এই সংকলনের মূল উদ্যোক্তা গাবতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কিছুদিন আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। বর্তমানে জয়পুরহাটে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

কেন এই উদ্যোগ? মনিরুজ্জামান জানালেন সে কথা, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। প্রশাসনের নিয়ম মেনে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের জানাতে হয় শেষবিদায়। প্রায় প্রতি মাসেই মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ না কেউ চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন। এমন একটা সময় আসবে, যখন নতুন প্রজন্ম আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে পারবে না। এটা ভেবেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিগুলো মলাটবন্দী করার পরিকল্পনা নেওয়া।’

মনিরুজ্জামান তাঁর এই পরিকল্পনার কথা জানালেন তাঁর বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুল্লাহ আল মামুনকে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর ও ইতিহাস বিভাগের তিনজন শিক্ষক, ত্রিশজন শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় দশজন ভিডিওম্যানকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুরু হয় স্টোরি টেলিং বা গল্প বলা পদ্ধতির আলোকে তথ্য সংগ্রহের কাজ। গাবতলী উপজেলার ২১২ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে মলাটবন্দী করা হলো মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস।

বইটিতে উঠে এসেছে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, প্রতিরোধযুদ্ধের কাহিনি, ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পথের ঘটনা, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতি, যুদ্ধে সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার করুণ কাহিনি, নিজে আহত হওয়ার বর্ণনা, দেশ স্বাধীন হলে তাঁদের ঘরে ফেরার গল্পসহ নানা বীরত্বগাথা।

গাবতলী উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে একটানা সাত দিন চলে এ তথ্য সংগ্রহের কাজ। তারপর বইয়ের সম্পাদনা ও গ্রন্থনা করতে লেগে যায় প্রায় ৯ মাস। অবশেষে গত ২২ এপ্রিল গাবতলী উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে ২১২ জন মুক্তিযোদ্ধাই অংশ নেন এবং তাঁদের সবার হাতে একটি করে বই তুলে দেওয়া হয়।

*জি এ মিল্টন, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়