মেলা বসিয়ে মাঠের দফারফা

ইন্দিরা রোড টিঅ্যান্ডটি মাঠটি ভাড়া দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সেখানে খেলার সুযোগ বন্ধ করে আয়োজন করা হয়েছে মেলার। বৃহস্পতিবার দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
ইন্দিরা রোড টিঅ্যান্ডটি মাঠটি ভাড়া দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সেখানে খেলার সুযোগ বন্ধ করে আয়োজন করা হয়েছে মেলার। বৃহস্পতিবার দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

রাজাবাজার, ইন্দিরা রোড ও আশপাশের এলাকার শিশু-কিশোরদের একমাত্র খেলার মাঠ ‘ইন্দিরা রোড টিঅ্যান্ডটি মাঠ’। কিন্তু সেখানে খেলার সুযোগ বন্ধ করে মেলা বসানো হয়েছে কিছুদিন ধরে। মেলার আয়োজন করতে গিয়ে মাঠের ক্ষতি করা হয়েছে। ফলে মেলা উঠে গেলেও খেলার পরিবেশ আদৌ থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ইন্দিরা রোড টিঅ্যান্ডটি মাঠটির মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই মাঠে নিয়মিত খেলাধুলা করত ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্র, ইন্দিরা রোড ক্রিকেট একাডেমি ও তেজগাঁও অগ্রগামী হকি দল। আশপাশের শিশু-কিশোরেরাও আসত মাঠে। এখন সেখানে আন্তর্জাতিক জামদানি হস্তশিল্প মেলার আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজক হিসেবে রয়েছে ‘জামদানি হ্যান্ডিক্র্যাফটস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’। ৭ রমজান থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত।

গত বৃহস্পতিবার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে পুরো মাঠে ইট বিছানো হয়েছে, জায়গায় জায়গায় মাটি খুঁড়ে খুঁটি গেড়ে স্টল বসানো হয়েছে। মাঠের চারপাশজুড়ে ও ভেতরে কয়েক সারিতে বসানো হয়েছে ৬০টি স্টল। মেলার নাম জামদানি হস্তশিল্প হলেও স্টলে ঠাঁই পেয়েছে ক্রোকারিজ, ইলেকট্রনিকস নানা ধরনের পণ্য। মেলার জন্য মাঠ ভাড়া দেওয়া বাবদ প্রতিদিন ১১ হাজার টাকা করে পাচ্ছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

খেলার মাঠ ভাড়া দেওয়া ২০০০ সালের খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন বলে জানিয়েছে মাঠ সুরক্ষায় কাজ করা ব্যক্তিরা। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, চাহিদার তুলনায় ঢাকা শহরে খেলার মাঠের পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ মানুষ খেলার মাঠের সুবিধা পান। এমন অবস্থায় খেলার মাঠে মেলার আয়োজন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মাঠের এমন ব্যবহার করলে সেই এলাকার মানুষ খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং মানুষের খেলার অভ্যাস নষ্ট হয়। এ ছাড়া মাঠের যে ক্ষতি হয় তাতে মাঠ আর আগের অবস্থায় পাওয়া যায় না।

মেলার মূল উদ্যোক্তা রিয়াদ আল ফয়সাল। তিনি জামদানি হ্যান্ডিক্র্যাফটস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সভাপতি। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও পুলিশের অনুমতি নিয়েই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় মোট ৬০টি স্টল রয়েছে, প্রতি স্টলের জন্য ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

এই আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, রমজান মাসে কেউ মাঠে খেলতে আসে না। তাই তাঁরা মেলার আয়োজন করেছেন। মেলা শেষে মাঠ সংস্কার করে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

আয়োজকেরা এমন দাবি করলেও বৃহস্পতিবার বিকেলে মাঠের পশ্চিম অংশে (মেলার সীমানার বাইরে) ৮-১০টি শিশু-কিশোরকে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে। তারা ইন্দিরা রোড ক্রিকেট একাডেমির সদস্য। এই একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, প্রতিদিন আশপাশের এলাকার অনেক শিশু-কিশোর মাঠে খেলত। মেলার কারণে এখন সব বন্ধ। তাদেরও খেলতে হচ্ছে এক কোনায়, ছোট্ট পরিসরে।

মেলা আয়োজনের অনুমতি আছে কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মেলার জন্য মাঠ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তো মাঠ সংরক্ষণ করি।’ তাহলে মেলা হচ্ছে কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখব’।

তবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (শেরেবাংলা নগর, বিভাগ-১) ফজলুল হক বলেন, ১৫ মে থেকে আগামী ১ জুন পর্যন্ত ১৬ দিনের জন্য মাঠে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আয়োজক সংগঠন প্রতিদিন ১১ হাজার টাকা করে ভাড়া দেবে। এ ছাড়া মাঠ সংস্কারের জন্য তাদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ‘নিরাপত্তা জামানত’ রাখা হয়েছে। এভাবে মাঠ ভাড়া দেওয়া আইনের লঙ্ঘন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, আইনের পাশাপাশি এ ব্যাপারে আদালতেরও সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। মাঠে মেলার আয়োজক ও অনুমোদনকারী উভয় পক্ষই আদালত অবমাননা করেছে।

টিঅ্যান্ডটি মাঠটিতে নিয়মিত খেলতে আসতেন এমন একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সবই হচ্ছে টাকার জন্য। এক মাসে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য হবে এই মাঠে। মানুষ খেলতে পারবে কি না, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আয়োজক সংগঠন ও গণপূর্তের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মাঠটি ব্যবহার করতে দেওয়া বাবদ গণপূর্ত ভাড়া পাবে ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। আর ৬০টি স্টল ৬০ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হলে আসবে ৩৬ লাখ টাকা।

মাঠটি পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (কাউন্সিলর) ফরিদুর রহমান খান। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মাঠ রক্ষায় তিনি কী পদক্ষেপ নিয়েছেন—জানতে চাইল বলেন, তাঁর বাধার কারণেই গত ১০ বছর এখানে মেলা হয়নি। তাঁর দাবি, মেলার অনুমতি দেওয়ার আগে তাঁর মতামত নেওয়া হয়নি। তাই অনুমতি দেওয়ার পর তিনি আর আটকাতে পারেননি।