সেই সাইফুল্লাহ ওজাকি ইরাকের কারাগারে

সাইফুল্লাহ ওজাকি
সাইফুল্লাহ ওজাকি

বাংলাদেশ থেকে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) সদস্য সংগ্রহ ও তাদের সিরিয়ায় পাঠানোর অন্যতম হোতা সাইফুল্লাহ ওজাকির খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি এখন ইরাকের কুর্দিস্তানের সুলাইমানিয়ার একটি কারাগারে বন্দী। মাস দুয়েক আগে কুর্দিস্তান কাউন্টার টেররিজম গ্রুপের (সিটিজি) কাছে আত্মসমর্পণ করেন ওজাকি।

বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে। সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সিরিয়ার বাঘুজে আইএসের শেষ ঘাঁটির পতনের পর অন্তত নয়জন বাংলাদেশি জঙ্গি আটক বা আত্মসমর্পণের খবর পেয়েছেন। এর মধ্যে তিনজনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। ওজাকি ছাড়া বাকি দুজন হলেন জুনায়েদ হাসান খান ও তাহমিদ শাফি। তাঁরা মার্কিন-সমর্থিত বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের (এসডিএফ) হাতে আটক হন। জুনায়েদ ১৩ মার্চ সিরিয়ার দায়র আজ জওর শহর থেকে আটক হন। আর ‘ক্লোজআপ তারকা’ তাহমিদ রহমান শাফি কবে আটক হন, সেই তারিখ পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, জুনায়েদের ভাই ইব্রাহীম হোসেন খান গত ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটিতে এক ড্রোন হামলায় নিহত হন বলে তাঁরা গত মার্চে তথ্য পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি কুর্দিস্তান কাউন্টার টেররিজম গ্রুপ (সিটিজি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠানো একটি বার্তা তাঁদের হাতে পৌঁছায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সাইফুল্লাহ ওজাকি গত ১৫ মার্চ সিরিয়ার বাঘুজ শহরে কুর্দি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। এরপর তাঁকে উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তানের সোলাইমানিয়া কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ওই বার্তায় আরও বলা হয়, ওজাকি ২০১৫ সালে সপরিবার জাপান থেকে বুলগেরিয়া হয়ে সিরিয়ায় যান। পরে এক বিমান হামলায় তাঁর জাপানি স্ত্রী এবং দুই সন্তান মুহাম্মাদ ও উম্মে সিরিয়ায় নিহত হন। তাঁর আরও তিন সন্তান ঈসা (৭), ইউসুফ (৩) ও সারাহ (১) এখনো সিরিয়ায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সিরিয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পাওয়ার কোনো সুযোগ তাঁদের নেই। তবে বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখবেন। তিনি বলেন, এর আগে জাপানি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে তাঁরা জেনেছিলেন যে সাইফুল্লাহ ওজাকির সর্বশেষ অবস্থান বুলগেরিয়ায়। এরপর তাঁর অবস্থান সম্পর্কে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, সাইফুল্লাহ ওজাকি আগে হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন। নাম ছিল সুজিত দেবনাথ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কড়ই গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে তিনি। ২০০১ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ২০০২ সালে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানকার এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান। বাবার ধারণা, জাপানে যাওয়ার পর সুজিত ধর্মান্তরিত হয়ে সাইফুল্লাহ ওজাকি নাম নেন। তিনি জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং এক জাপানি নারীকে বিয়ে করে সেখানেই সংসার শুরু করেন।

জাপানের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র অনুযায়ী, ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর রিতসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেন ওজাকি। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে অনুপস্থিত থাকায় ওই বছরের মার্চে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে।

জঙ্গি বিষয়ে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সিরিয়া গেছেন, তাঁদের বড় অংশই গেছেন এই সাইফুল্লাহ ওজাকির মাধ্যমে, যাঁরা মূলত বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা করেছেন।

২০১৭ সালের ২৯ জুলাই এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ২০১৫ সালে উত্তরা থেকে আমিনুল ইসলাম বেগকে গ্রেপ্তারের পর সাইফুল্লাহ ওজাকির নাম তাঁরা জানতে পারেন। তিনি কিছু লোককে এ দেশ থেকে সিরিয়ায় যেতে সহযোগিতা করেছিলেন।

২০১৫ সালের ২৪ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাইফুল্লাহ ওজাকি, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আমিনুল ইসলাম বেগসহ আটজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়। গত ২৫ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাতে বলা হয়, আসামিরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে তাঁদের সংগঠন তৈরি, সদস্য সংগ্রহ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বলে তদন্তে প্রকাশ পায়।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ওজাকি ফেসবুকে ‘এক্স ক্যাডেট ইসলামিক লার্নিং ফোরাম’ নামে একটি পেজ খুলে আইএসের মতাদর্শ প্রচার করতেন। তিনি বাংলাদেশে নাশকতার জন্য এবং সিরিয়ার আইএসের হয়ে কাজ করার জন্য অর্থায়ন করেন।

ওজাকির হাত ধরে ঠিক কতজন বাংলাদেশি আইএসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়া গেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মাধ্যমে সিরিয়ায় গিয়ে পরে দেশে ফিরে আসা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রকৌশলী গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আটক হন। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গাজী কামরুস সালাম বলেছিলেন, তিনি ছাড়াও সিলেট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মো. মহিবুর রহমান ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারী সিরিয়ায় গেছেন ওজাকির মাধ্যমে।

সাইফুল্লাহ ওজাকির বাবা জনার্দন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালের দিকে স্থানীয় পুলিশ একদিন তাঁদের বাড়িতে এসে ওজাকি জঙ্গি অর্থায়ন করেছেন বলে জানিয়েছিল। তিনি তখন মুঠোফোনে জাপানে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। ওজাকি তখন দাবি করেছিলেন, জঙ্গিবাদে নয়, এতিমদের তিনি টাকা দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল ছেলের সঙ্গে জনার্দনের শেষ কথা।

বাংলাদেশ থেকে ঠিক কতজন সিরিয়া গেছেন, তাঁদের কতজন মারা গেছেন, জীবিতরা কে কোথায় আছেন, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব বা তথ্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, পশ্চিমাদের একটি দেশের কাছে প্রবাসী সন্ত্রাসবাদী যোদ্ধাদের (ফরেন টেররিস্ট ফাইটার্স বা এফটিএফ) যে তালিকা রয়েছে, তাতে সিরিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৪০ জনের বেশি। তাঁরা মূলত ২০১৪-১৫ সালে দেশ ত্যাগ করেন। এর বাইরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিভিন্ন দেশের নাগরিক এমন বেশ কয়েকজন সিরিয়ায় গেছেন, যা বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।