ক্যাম্পাসে চায়ের সঙ্গে পাতার বাঁশির প্রশান্তি

ক্যাম্পাসে চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন শরীফুল ইসলাম। পাশাপাশি পাতার বাঁশি বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেন তিনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। ছবি: প্রথম আলো
ক্যাম্পাসে চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন শরীফুল ইসলাম। পাশাপাশি পাতার বাঁশি বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেন তিনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। ছবি: প্রথম আলো

শরীফুল ইসলাম। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গার মোল্লাপাড়ায় ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া মানুষটি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের সাক্ষী। দেখছেন বর্তমান বাংলাদেশের হালচাল। চোখের সামনে দেখেছেন ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিকালদর্শী এই মানুষটি লাঠিতে ভর দিয়ে প্রতিদিন আসেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।

রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবনের সামনে ছোট্ট চায়ের দোকান তাঁর। ২৮ বছর ধরে ক্যাম্পাসে চা বিক্রি করেন তিনি। দোকানের নাম ‘পাতার বাঁশি চাচার দোকান’। নামটা কিন্তু এমনিতেই হয়নি। পাতা দিয়ে তাঁর অসাধারণ বাঁশি বাজানোর দক্ষতার কারণেই দোকানের এই নাম। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো গাছের পাতা দিয়েই বাঁশি বাজাতে পারেন তিনি। তবে জামগাছের পাতা দিয়েই বেশি বাঁশি বাজান শরীফুল। যেকোনো গানের সুরই নিজের বাঁশিতে তুলতে পারেন এই প্রবীণ ব্যক্তি।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছিলেন বলে জানান শরীফুল ইসলাম। যুদ্ধের সময় এক গ্রেনেড হামলায় বাঁ পাশের চোখটি হারান বলেও দাবি করেন তিনি। ছয় সন্তানের জনক হলেও নিজের খরচ তাঁকে নিজেকেই চালাতে হয়। ৭২ বছর বয়সী স্ত্রীই এখনো কষ্ট করে রান্নাবান্না ও গৃহস্থালির কাজ করে থাকেন। ছেলেমেয়েরা খোঁজখবর নেন কি না, জানতে চাইলে চুপ হয়ে যান এই পাতার বাঁশিবাদক।

বাঁশি বাজানোর ইতিহাস ব্যাখ্যা করে শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘যখন স্কুলে যেতাম পাশের গ্রামের হিন্দু বাড়িতে পূজার সময় দেখতাম পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে। তারপর একদিন স্কুল বাদ দিয়ে বেশ কদিন এই বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করতে করতেই হয়ে গেল। সেই ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু।’ মূলত পাতা দিয়ে বাঁশি বাজালেও আড় বাঁশি, ভেঁপু বাঁশিসহ কয়েক ধরনের বাঁশি বাজাতে পারেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের  প্রভাষক শরিফুল ইসলাম জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চাচার দোকানে আড্ডা দিতাম আমরা। সেই তখন থেকেই তাঁর বাঁশির ভক্ত আমরা। এখনো সময় পেলে তাঁর বাঁশির সুর শুনতে মাঝে মাঝে যাই।’

মনের খেয়ালে বাঁশি বাজালেও চায়ের দোকানের ওপর চলে শরীফুল ইসলামের সংসার। চায়ে চুমুক দিয়ে পাতার বাঁশি শুনে অনেকে প্রশান্তি খুঁজে পান। ফলে তাঁর দোকানে পাতার বাঁশির সুরের তালে বন্ধুদের মধ্যে আড্ডাটাও বেশ জমে ভালো। তবে পাতার বাঁশির এই কারিগরের কণ্ঠে কিঞ্চিৎ আক্ষেপের সুর। তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো সুর ওঠে না।’ তবে কেউ এসে আবদার করলে তাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনান। আলাপচারিতা শেষে বাঁশি বাজানোর আহ্বান জানালে সানন্দেই সাড়া দিলেন শরীফুল। জামগাছের একটি পাতা নিয়ে সুর তোলেন, ‘আমার গলার হার, খুলে নে ওগো ললিতে।’