বাজারে নিষিদ্ধ পিরানহা

যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে ১৫ মে বিক্রি হচ্ছিল পিরানহা। পরে মৎস্য অধিদপ্তর ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তা জব্দ করেন।  ছবি: প্রথম আলো
যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে ১৫ মে বিক্রি হচ্ছিল পিরানহা। পরে মৎস্য অধিদপ্তর ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তা জব্দ করেন। ছবি: প্রথম আলো

যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের এক পাশে সামুদ্রিক রুপচাঁদা মাছ বলে পিরানহা বিক্রি করছিলেন এক মাছ বিক্রেতা। দিনমজুর আবদুল হামিদ এসেছিলেন মাছ কিনতে। মাছের কেজি কত জানতে চাইলে বিক্রেতা তাঁকে বলেন, একদম তাজা ‘সামুদ্রিক চান্দা’, ২০০ টাকা কেজি। দরদাম করে হামিদ কিনলেন ১৫০ টাকা কেজিতে।

 কী মাছ কিনলেন, জানতে চাইলে হামিদ উত্তর দিলেন—সমুদ্রের চান্দা। তাঁকে যখন বলা হলো এটা চান্দা নয়, রাক্ষুসে পিরানহা, তিনি সে কথায় কান না দিয়ে ঘরের পথে দ্রুত হাঁটা দিলেন।

এই আড়তের আশপাশের আরও কয়েকজন মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকায় কয়েক মাস ধরে প্রায়ই আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছ বিক্রি হচ্ছে। দাম কম বলে নিম্ন আয়ের মানুষ এসব মাছ কিনে নিয়ে যান। তবে মাঝেমধ্যে অভিযান হলে কিছুদিন এসব মাছ বিক্রয় বন্ধ থাকে।

অনেকেই জানেন না, অনেকটা রুপচাঁদা মাছের মতো দেখতে এই মাছের নাম পিরানহা। সরকার পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুরের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এই নিষিদ্ধ মাছ প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে।

গত শুক্রবার গ্রিন রোডের আইবিএ হোস্টেলের পাশে বিক্রি হতে দেখা গেছে আফ্রিকান মাগুর। বিক্রেতা আবদুল মালেক জানালেন, এই মাছ বিক্রয় যে নিষিদ্ধ, তা তিনি জানতেন না। তবে আশপাশের মাছ বিক্রেতারা জানান, মালেক প্রায়ই এখানে আফ্রিকান মাগুর এনে বিক্রি করেন।

তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে গত সপ্তাহে বিক্রি হতে দেখা গেছে পিরানহা মাছ। একটি রিকশা গ্যারেজে রান্না করেন আকলিমা খাতুন। দাম কম বলে তিনি এই মাছ কিনছিলেন। এখানেও বিক্রেতা রুপচাঁদা বলে পিরানহা বিক্রি করছিলেন। ক্রেতাদের কাছে মিথ্যা কথা বলছেন কেন, জানতে চাইলে বিক্রেতা কোনো জবাব দেননি।

এই এলাকার বাসিন্দা সামসুল হোসেন জানালেন, প্রায়ই এখানে কিছু বিক্রেতা পিরানহা এনে বিক্রি করেন।

ঢাকা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, বাংলাদেশের জলজ পরিবেশের সঙ্গে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর মাছ সংগতিপূর্ণ নয়। এগুলো রাক্ষুসে স্বভাবের। অন্য মাছ ও জলজ প্রাণীদের খেয়ে ফেলে। দেশীয় প্রজাতির মাছ তথা জীববৈচিত্র্যের জন্য এগুলো হুমকিস্বরূপ। এ কারণে সরকার ও মৎস্য অধিদপ্তর আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছের পোনা উৎপাদন, চাষ, উৎপাদন, বংশ বৃদ্ধিকরণ, বাজারে ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। তিনি জানান, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পিরানহা এবং ২০১৪ সালের জুন থেকে আফ্রিকান মাগুরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

অনুসন্ধান করে এবং মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকা ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলের ডোবা বা পুকুরে পিরানহার উৎপাদন ও চাষ করা হচ্ছে। আর আফ্রিকান মাগুরের চাষ হচ্ছে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জের অব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত জলাশয়, ডোবা, নালায়। বিক্রির উপযুক্ত হলে ট্রাকে করে এসব মাছ রাজধানীর বিভিন্ন মাছের আড়ত ও বাজারে আনা হয়। পিরানহা বাজারভেদে ১৫০-২০০ টাকা কেজি ও আফ্রিকান মাগুর বাজারভেদে ১২০-১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়ত, কারওয়ান বাজার ও সোয়ারীঘাট মৎস্য আড়ত, তেজগাঁও বাজার, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাজার থেকে ঢাকার মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত অঞ্চলের বাজারগুলোতে কিছু অসাধু বিক্রেতা এসব মাছ বিক্রি করছেন। সাধারণত নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ক্রেতারা এসব মাছের ক্রেতা। দেশি বা থাই রুপচাঁদা কিংবা ‘সামুদ্রিক চান্দা’ নামে পিরানহা আর দেশি মাগুর বলে ছোট আকারের আফ্রিকান মাগুর বিক্রি করা হয়।

মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন জানান, রাজধানীতে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর বিক্রি বন্ধ করতে তাঁরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। গত মার্চ মাস থেকে ১৫ মে পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়ত, কারওয়ান বাজার ও সোয়ারীঘাট মৎস্য আড়ত থেকে তাঁরা ৫ মেট্রিক টন পিরানহা এবং ৩ মেট্রিক টন আফ্রিকান মাগুর জব্দ করেছেন। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন বিক্রেতাকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।

পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর মাছের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার নেতৃত্ব দিয়েছেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। তিনি বলেন, অন্য মাছের কথা বলে কম দামে পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে।