তিন বছর নিখোঁজের পর হঠাৎ আদালতে

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসিন মোহাম্মদ আবদুস সামাদ। ফাইল ছবি
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসিন মোহাম্মদ আবদুস সামাদ। ফাইল ছবি

২০১৬ সালের ১৪ জুলাই দুপুরে বনানী রেলস্টেশনের সামনে থেকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসিন মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে (৩৭)। এ ঘটনায় তাঁর মা চিকিৎসক সুরাইয়া পারভীন বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর কোনো সন্ধান করতে পারেনি।

প্রায় তিন বছর পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, ইয়াসিন সামাদকে ১৭ মে বনানীর গাউসুল আযম মসজিদের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতার ‘প্রত্যক্ষ মদদদাতা’।

ইয়াসিন মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে গত শুক্রবার ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় ডিএমপি। গুলশান থানায় ২০১৩ সালে করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একই মামলায় ২০১৬ সালের ১৭ মে থেকে নিখোঁজ তেহজীব করিমকেও (৩৪) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আদালত রিমান্ডের বিষয়ে শুনানির জন্য ২২ মে তারিখ নির্ধারণ করেছেন।

রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসে ইয়াসিনদের নিজেদের বাড়ি। বাবা নেই, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। মা সুরাইয়া পারভীন তালুকদারও চিকিৎসক। ছেলেকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে ওই দিনই তিনি ভাষানটেক থানায় যে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তাতে বলেন, ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই বনানী রেলস্টেশনের কাছ থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রেলস্টেশনের এক টিকিট বিক্রেতা তাঁদের জানান, সাধারণ পোশাক পরা লোকজন তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে।

ইয়াসিনের পরিবারের অভিযোগ, ইয়াসিন নিখোঁজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিয়ে যান। এ নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর প্রথম আলোতে ‘চার মাস ধরে নিখোঁজ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকা আদায়’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হাজী আলম নামে যে ব্যক্তি ইয়াসিনের পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন, প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

ইয়াসিনের মা সুরাইয়া পারভীন তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, তাঁর ছেলেকে জঙ্গিবাদে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর ছেলে ধর্মপ্রাণ, তবে জঙ্গিবাদের মতো হিংস্র কোনো কাজে যুক্ত নন।

গত শুক্রবার আদালতে দেওয়া রিমান্ড আবেদনে ডিবির গোয়েন্দা (দক্ষিণ) বিভাগের ধানমন্ডি জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম বলেছেন, ইয়াসিন ও তেহজীবের প্রত্যক্ষ মদদে বাংলাদেশের প্রথম আল–কায়েদার মতাদর্শী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুসলিমিন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ১৭টি দেশে জঙ্গি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তেহজীব জামাতুল মুসলিমিনের (জেএম) সক্রিয় সদস্য। তিনি লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক। ২০১০ সালে তিনি ইয়েমেনের জঙ্গিনেতা আনওয়ার আল আওলাকির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি ১০ মাস কারাভোগ করেন। তেহজীব করিমের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর বড় ভাই রাজীব করিম আল–কায়েদার মতাদর্শী এবং ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে হামলার পরিকল্পনাকারী ছিলেন। এর দায়ে তাঁর ৩০ বছর কারাদণ্ড হয়ে লন্ডনের জেলহাজতে রয়েছেন। ইয়াসিন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আমির এবং এই মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামি মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।

>

২০১৬ সালের ১৪ জুলাই ইয়াসিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ
ইয়াসিনকে গত শুক্রবার ঢাকার আদালতে হাজির করে ডিএমপি
ইয়াসিনকে ১৭ মে বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পুলিশ
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে

রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের মূল পরিকল্পনাকারী এবং এই মামলার গ্রেপ্তারকৃত আরেক আসামি রিজওয়ান হারুনের সঙ্গেও ইয়াসিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ২০০৫ সালে জামাতুল মুসলিমিনের কার্যকলাপ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসে। জেএমের সব সদস্য জঙ্গি কার্যক্রম দ্রুত বিস্তারের জন্য রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামক এনজিওর ছত্রচ্ছায়ায় জঙ্গিদের দলে ভেড়ানোর কাজ করতেন।

নিখোঁজের প্রায় তিন বছর পর গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে জানতে তেহজীবের বাবা জয়নুল করিমের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৬ সালে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, তেহজীব থাইল্যান্ডে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষকতার ওপর একটি কোর্স শেষ করে ২০১৬ সালের ১৭ মে বিকেলে দেশে ফেরার পর ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজ হন।

তেহজীবদের পারিবারিক আইনজীবী মুরশেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তেহজীবের মা মমতাজ বেগম শুক্রবার তাঁকে জানিয়েছিলেন তেহজীবের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।

ইয়াসিনের মা সুরাইয়া পারভীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াসিনকে শুক্রবার আদালতে তোলা হয়েছে, সে বিষয়টি পুলিশ তাঁদের জানায়নি। এক আইনজীবী তাঁদের বিষয়টি জানান। পুলিশ জঙ্গিবাদের সঙ্গে তাঁর ছেলের যে সম্পৃক্ততার কথা বলছে, তা–ও ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

এ দুজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে গতকাল ডিবির ধানমন্ডি জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. আহসান খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে শুধু বলেন, ‘দুজনের বিরুদ্ধেই জঙ্গিবাদের অভিযোগ রয়েছে।’ এর বেশি আর কিছু জানাতে চাননি তিনি।