মামলায় ধর্ষণের বিষয় উল্লেখ নেই, ওসি প্রত্যাহার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় স্কুলছাত্রী অপহরণের চার দিন পর মামলা রেকর্ড করা হয়। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা স্কুলছাত্রীর বাড়ি থেকে পরে যাওয়া পায়জামাটি পাওয়া না গেলেও মামলার অভিযোগে এ কথা উল্লেখ করা হয়নি। অভিযোগে আরও নেই ধর্ষণের বিষয়টি।

বাদীপক্ষের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার বিকেলে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর মোহনপুর সদরে নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আকতারকে (১৪) প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় মুখে রুমাল চেপে অপহরণ করা হয়। ওই দিন বিকেলে তাকে অচেতন অবস্থায় উপজেলার বাগবাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। তাকে প্রথমে মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেন স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আকতারের বাবাকে হেনস্তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মা ও বোনকেও পুলিশ অপমান করেছে বলে সুমাইয়ার পরিবারের অভিযোগ। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে মামলা নেওয়া হয়। কিন্তু আসামিদের পরিবার নানা সময় সুমাইয়া ও তার পরিবারকে অপমান করতে থাকে। সুমাইয়া গত ১৭ মে বিকেলে চিরকুটে তার অপমানের কথা লিখে রাখে। এরপর ঘর থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।

স্কুলছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, স্কুলছাত্রী অপহরণের পর আসামি ধরে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। ঘটনার চার দিন পর পুলিশ সুপার নির্দেশ দেওয়ার পরে মামলা রেকর্ড করা হয়। তারপরও পুলিশের ইচ্ছামতো এজাহার লেখানো হয়েছে। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা স্কুলছাত্রীর পরনে অন্য জামাকাপড় ছিল। বাড়ি থেকে পরে যাওয়া পায়জামাটি পাওয়াই যায়নি। এরপরও মামলায় ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করেনি। ঘটনাস্থলে তিনজন উপস্থিত থাকলেও শুধু দুজনকে আসামি করা হয়েছে। এই অভিযোগে আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পুলিশের অবহেলার বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান সিদ্দিকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রোববার বিকেল থেকেই কাজ শুরু করেছে। স্কুলছাত্রীর বাবা, মা ও বোনের বক্তব্য নিয়েছে।

সুমাইয়ার বাবা আবদুল মান্নান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার বিকেলে তদন্ত কমিটির কাছে সব খুলে বলেছেন। তিনি বলেন, তাঁর মেয়েকে অপহরণের পর পুলিশ প্রধান আসামি মুকুলকে আটক করে পরের দিনই আবার ছেড়ে দেয়। তিনি মামলা করতে গেলে মামলা নিয়ে তাঁকে ঘোরাতে থাকেন। সকাল আটটায় গিয়ে বিকেল পাঁচটায়ও মামলা না নিয়ে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পরের দিন ২৫ এপ্রিল তিনি গিয়ে বলেছেন মামলা না নিতে পারলে বলে দেন মামলা নিতে পারবেন না। এ কথা শুনে ওসি তাঁকে মেরে দাঁত ভেঙে দিতে চান।

আবদুল মান্নান বলেন, রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলমগীর কবির একসময় মোহনপুর উপজেলার ইউএনও ছিলেন। তিনি তাঁর কাছে যান। ঘটনা শোনার পরে তিনি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ফোন করে বলেন। এরপর ২৭ এপ্রিল পুলিশ সুপার মেয়েসহ দেখা করতে বলেন। তিনি সব শুনে ওসিকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই দিনই ওসি মামলা নেন, কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো এজাহার লিখতে বাধ্য করেন। অপহরণের সময় দোলোয়ার নামের আরেকজন লোক ছিলেন, তাঁর নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করেননি।

সুমাইয়ার বোন জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, তাঁর বোন বাড়ি থেকে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় তার বান্ধবী সোনিয়া এসে বলেছিল, সুমাইয়া নতুন যে জামা বানিয়েছে, ওটা যেন সঙ্গে নেয়। ওটা দেখে তার একজন বান্ধবী জামা বানাবে। তিনি বলেন, যখন তার বোনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তখন তার গায়ে ব্যাগের জামাটি পরানো অবস্থায় পাওয়া যায়। যে জামাটি পরনে ছিল সেটি ধুয়ে নেড়ে দেওয়া ছিল। পরনে অন্য একটা পায়জামা ছিল। যেটা পরে গিয়েছিল, সেটি পাওয়াই যায়নি। এরপরও মামলায় ধর্ষণের প্রসঙ্গটি ওসি উল্লেখ করতে দেয়নি। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, ধর্ষণের আলামত নষ্ট করে প্রতিবেদনটা আসামিরা টাকা দিয়ে তাঁদের অনুকূলে করে নেন কি না। তিনি বলেন, থানায় দারোগা সাইফুল তাঁকেও অপমান করেছেন। তাঁকেও খারাপ মেয়ে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, মুকুল তাঁর বোনকে যে চিঠি দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই চিঠিটিও তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন।

সুমাইয়ার মা ফরিদা বেগম বলেন, থানার ভেতরে পুলিশ তাঁদের কথা শোনার আগেই আসামি সোনিয়ার মায়ের কথা শুনছেন। এ সময় সোনিয়ার মা তাঁদের পরিবার সম্পর্কে বাজে কথা বলছিলেন। প্রতিবাদ করতে গেলে ওসি তাঁকে অপমান করে বের করে দেন।

রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি ) মো. শহিদুল্লাহ মোহনপুর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি নির্দেশ দেওয়ার পরই মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। তিনি বলেন, স্কুলছাত্রীকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছিল। মামলার পরের দিনই তার ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এখনো পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান সিদ্দিকী বলেন, তাঁদের তদন্ত চলছে। যথাসময়ে তাঁরা প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এখনো সব সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলা হয়নি।

গত বৃহস্পতিবার (১৭ মে) সুমাইয়া একটি চিরকুটে বাবা-মায়ের উদ্দেশে লিখেছে, ‘তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক আদর, অনেক ভালোবাসা। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে তার মানসম্মান সবচেয়ে বড়। নিজের লজ্জার কথা বারবার সবাইকে বলতে বলতে বলতে আমি নিজের কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। প্রতিদিন পরপুরুষের কাছে এসব বলতে বলতে আমি আর পারছি না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো আর নিজের মানসম্মান ফেরত পাব না। তাই আমাকে ক্ষমা করো।’ এরপরই শয়নকক্ষ থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।