যুদ্ধফেরত জঙ্গি ঠেকাতে ট্রাভেল পারমিট বন্ধ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সিরিয়া ও ইরাকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে যুদ্ধ করতে যাওয়া জঙ্গিরা এ দেশে ঢুকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়া কাউকে ট্রাভেল পারমিট (ভ্রমণের অনুমতিপত্র) না দিতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়, যা বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

১৬ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের বহিরাগমন শাখা থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গি তৎপরতার কারণে নিরাপত্তাঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জাতীয়তা ও প্রাক্-পরিচিতি যাচাই ছাড়া কাউকে ট্রাভেল পারমিট দেওয়া হলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এতে পরিচয় গোপন করে যুদ্ধফেরত জঙ্গি ও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া কাউকে ট্রাভেল পারমিট না দেওয়ার জন্য মিশন বা দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।

>স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ছাড়া কাউকে ট্রাভেল পারমিট না দিতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধফেরত কোনো জঙ্গি যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য আগেই বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী জঙ্গিদের ছবিসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য বিমানবন্দরে দেওয়া আছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জানিয়েছে, সেখানকার নাগরিক কিন্তু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমন জঙ্গিরাও বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। এদের সম্পর্কে বাংলাদেশি সংস্থাগুলোর কাছে তেমন তথ্য নেই। তবে তাদের যেহেতু পাসপোর্ট নেই, তারা দূতাবাস থেকে ট্রাভেল পারমিট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। তাই দেশে ফেরার আগেই সবার পরিচিতি যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলেই যে কেউ ট্রাভেল পারমিট দিয়ে দেশে ফিরতে পারবে।’

এ সিদ্ধান্তের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাঁরা কোনো কারণে পাসপোর্ট হারিয়েছেন, তাঁরা সমস্যায় পড়বেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এমন ক্ষেত্রে আমরা ই-মেইলে বা ফ্যাক্সে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে দেব।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের (ইসলামিক স্টেট) মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশ থেকে অনেকে সিরিয়া ও ইরাকে গেছেন। এর সঠিক সংখ্যা কত এবং তাঁদের কতজন মারা গেছেন ও জীবিতরা কে কোথায় আছেন, তার পূর্ণাঙ্গ কোনো হিসাব বা তথ্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, পশ্চিমা একটি দেশের কাছে প্রবাসী সন্ত্রাসবাদী যোদ্ধাদের (ফরেন টেররিস্ট ফাইটারস বা এফটিএফ) যে তালিকা রয়েছে, তাতে সিরিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৪০ জনের বেশি। তাঁরা মূলত ২০১৪-১৫ সালে দেশ ত্যাগ করেন। তাঁদের অনেকে মারা গেছেন এবং কেউ কেউ ধরা পড়ে সিরিয়া বা ইরাকের বন্দিশালায় আছেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পাচ্ছে। এর বাইরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেক বিদেশি নাগরিক সিরিয়ায় গেছেন।

সিরিয়ায় আইএসের পতন হওয়ার পর সেখানকার বিদেশি যোদ্ধারা নিজ নিজ দেশে ফিরতে পারে, এ আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশে উদ্বেগ রয়েছে। যার কারণে সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা মনে করেন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক ও লেবানন যুদ্ধফেরত জঙ্গিরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে। তাই এসব দেশ থেকে যারাই আসবে, তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে মুতাজ আবদুল মজিদ নামে এক তরুণ তুরস্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন। আগাম খবর পেয়ে তাঁকে বিমানবন্দর থেকেই হেফাজতে নেওয়া হয়। পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সৌদি আরবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই তরুণ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট নেন। ওই পাসপোর্টে তিনি ২০১৬ সালে তুরস্কে যান। তুরস্ক পুলিশের এক অভিযানে মুতাজ আটক হন। পরে তাঁকে বাংলাদেশগামী বিমানে তুলে দেয় তারা। অবশ্য মুতাজ সিরিয়ায় কোনো জঙ্গির পক্ষে লড়াই করেছেন কি না, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জঙ্গিদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাই তারা যেকোনো দেশে ঢুকতে চাইলে ট্রাভেল পাস নিয়েই ঢোকার চেষ্টা করবে। অনেক সময় দেখা যায়, অবৈধ শ্রমিকদের দেশে ফেরাতে অনেকেই দ্রুত ট্রাভেল পাস চায়। তাই শ্রমিক হিসেবে যাতে জঙ্গিদের কেউ ট্রাভেল পাস নিয়ে চলে আসতে না পারে, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে তবেই ট্রাভেল পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।