'রেলের অ্যাপস খালি ঘোরে, টিকিট পাইছি সাধনা করে'

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট হাতে পেয়ে তা দেখাচ্ছেন এক তরুণ। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ২২ মে। ছবি: আবদুস সালাম
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট হাতে পেয়ে তা দেখাচ্ছেন এক তরুণ। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ২২ মে। ছবি: আবদুস সালাম

কমলাপুর রেলস্টেশন। ঘড়ির কাঁটায় সময় বুধবার সকাল ৯টা ১৮ মিনিট। স্টেশনের ১৬ নম্বর কাউন্টারের সামনে টিকিট নিয়ে ‘বিজয়ী উল্লাসে’ মেতে ওঠেন মো. রায়হান নামের এক যুবক। ট্রফির মতো করে টিকিট উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করেন তিনি। খানিকটা এগিয়ে এসে রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটার সময় কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছি। আজ সকাল সোয়া নয়টার পর দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনের এসির চারটি টিকিট পাইছি।’

মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে টিকিট কিনতে পারতেন? এত কষ্ট করলেন কেন? প্রশ্নের উত্তরে রায়হান বলেন, ‘অ্যাপস কাজ করছে না। ৩০ মের টিকিটের জন্য গতকাল অ্যাপস লগইন করছি। লগইন ফেল দেখাচ্ছে। বলছে, ৫০ পারসেন্ট টিকিট বিক্রি করবে। কিন্তু ৫ পারসেন্টও পাওয়া যাচ্ছে না। অ্যাপস খালি ঘোরে। টিকিট পাইছি সাধনা করে।’

রায়হানের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনীক নামের এক যুবক। তিনি বলেন, ‘২৯ মের টিকিট অ্যাপসে পাওয়া গেছে। ভালোভাবেই টিকিট কেনা গেছে। কিন্তু গতকাল থেকে অ্যাপস কাজই করছে না। রাত ১০টার পর থেকে তো অ্যাপস খুলছেই না। অ্যাপস যদি কাজ না-ই করবে, তাহলে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রির কথা বলা হলো কেন?’

রায়হান, অনীকদের মতো অ্যাপসে টিকিট কেনা নিয়ে একের পর এক অভিযোগ শোনা যায় ঠাকুরগাঁওয়ের আবুল কাশেম, আবু তাহের, নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১৭ নম্বর কাউন্টারের আফিফা নওশিনের মুখে।

তাঁদের কাছ থেকে অভিযোগ জানার আধা ঘণ্টার পর সকাল ১০টার কিছু পর টিকিট বিক্রির কার্যক্রম দেখতে আসেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

প্রায় মিনিট বিশেক টিকিট বিক্রির কার্যক্রম দেখেন এবং টিকিটপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলেন রেলমন্ত্রী। তিনি আসার কিছুক্ষণ আগে অনলাইনে টিকিট পেতে ভোগান্তির অভিযোগ পেয়ে কমলাপুরে অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমের সার্ভার রুমে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দল। আজ সকাল ১০টার দিকে দুদকের তিন সদস্যের একটি দল এই অভিযান চালায়। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন। তাঁরা অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমের সার্ভারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।


অভিযান শেষে দুদকের উপসহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা টিকিট সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে এসেছি। এখানে অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমের সার্ভারের কর্মকর্তারা বলেছেন, সার্ভার ডাউন হয়ে যাচ্ছে। তাই টিকিট পেতে একটু সমস্যা হচ্ছে। সার্ভার ডেভেলপমেন্টের কাজ চলছে।’

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, এবার অনলাইনে অ্যাপের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হচ্ছে। হটলাইনে পাওয়া ওই অভিযোগে বলা হয়, টিকিট বিক্রি শুরুর পর থেকেই অ্যাপটি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। গ্রাহক টিকিট কিনতে পারছেন না। অভিযানে এসেও ওই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এটি নিয়ে জানতে চাইলে অ্যাপ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

অনেক কষ্টের পর টিকিট পেয়ে মুখে বিজয়ের হাসি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ২২ মে। ছবি: আবদুস সালাম
অনেক কষ্টের পর টিকিট পেয়ে মুখে বিজয়ের হাসি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা, ২২ মে। ছবি: আবদুস সালাম

এবার অ্যাপে টিকিট বিক্রি পরিচালনা করছে সিএনএস (কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের (অপারেশন) কাছে অ্যাপস নিষ্ক্রিয় থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, অতিরিক্ত চাপের কারণে সার্ভার ডাউন হয়ে আছে। এই উত্তরে আমরা সন্তুষ্ট না। আরও তদন্ত করে কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এবং সেই অনুযায়ী কমিশন আগামী কিছুদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেবে।’

দুদক দল চলে যাওয়ার পর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, অ্যাপস নিয়ে অনেক অভিযোগ এসেছে। কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে এটি দুঃখজনক। পুরোপুরি সার্ভিস ভবিষ্যতে বিড়ম্বনা ছাড়াই ঈদের পর প্রদান করা যাবে।

রেলের অ্যাপসে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে গণমাধ্যমকর্মীরা মন্ত্রীকে জানান। তখন মন্ত্রী বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাঁচ দিনের মধ্যে যদি টিকিট বিক্রি না হয় বা কোনো যাত্রী টিকিট না পেয়ে থাকেন, তাহলে অবিক্রীত টিকিট ২৭ মে থেকে কাউন্টারের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে।
অ্যাপসে তো টিকিট নিল (শূন্য) দেখাচ্ছে, তা জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘অ্যাপসে হয়তো কোনো ডিফেক্ট থাকতে পারে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘গতকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে ১৪ হাজার ৭৫৪টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ৫ হাজার ২৮২টি টিকিট বিক্রি হয়েছে।’

এখন পর্যন্ত কেউ একটি টিকিট পায়নি। সিএনএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এই সিএনএস ২০০৭ সাল থেকে রেলওয়ের সঙ্গে সার্ভিস দিয়ে আসছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে একটা চুক্তি আছে।’

রেলমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তারা আমাদের কাছে দরখাস্ত দিয়েছে। আমরা বলেছি যে তোমাদের সার্ভিস যদি নিশ্চিত করতে পারো, তখন আমরা সেটা বিবেচনা করব। এটিকে সেটিসফাই করার জন্য তারা নতুন করে মোবাইল অ্যাপস চালু করার মধ্য দিয়ে সার্ভিস ডেভেলপ করার চেষ্টা করেছে। এটাতে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনারা শতভাগ নিশ্চিত থাকেন যে এই সিএনএস কোম্পানির সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আর রেলের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’

এটি রেলওয়ের ব্যর্থতা কি না, তা জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, ব্যর্থতা তো বটেই। কেন আমরা (রেলওয়ে) ব্যর্থতা ঘাড়ে নেব না। যদি সিএনএস কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস না দিতে পারে, সেটা অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। তবে বিকল্প ব্যবস্থা আমরা রেখেছি। পাঁচ দিন পর তো টিকিট বিক্রি করা হবে। কাউন্টারের মাধ্যমে দেব।’

পাঁচ দিন পর তো ৫০ শতাংশ টিকিট আর থাকছে না—এর জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘টিকিট তো সেল হবেই। লিমিটেড টিকিট সেল হবে না! সাধারণ মানুষের জন্য কাউন্টার রেখেছি। পাঁচ দিন পর যেটুকু বাকি থাকবে, আমার কাছে তো রেকর্ড থাকছে। এটা তো কাউন্টার থেকে বিক্রি হচ্ছে না। পাঁচ দিন পরে ডিসক্লোজ করব আপনাদের সামনে, কত পারসেন্ট টিকিট মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে বিক্রি হলো না। সেই টিকিট আমরা কাউন্টারের মাধ্যমে দেব।’